সাতক্ষীরায় ভাইরাস ও মড়কে চিংড়ি চাষে মারাত্মক বিপর্যয় ॥ দিশেহারা কৃষক
সাতক্ষীরা জেলা সদরসহ ছয়টি উপজেলায় প্রায় অর্ধলক্ষ হেক্টর জমিতে সাদা সোনা নামে খ্যাত বাগদা,গলদা ও হরিনা প্রজাতির চিংড়ি মাছের চাষ হয়। এদেশ থেকে যে পরিমান চিংড়ি মাছ রপ্তানি হয় তার সিংহভাগই উৎপাদন হয় এ জেলায়। তবে বাঁগদা ও গলদা দেশের বাইরে রপ্তানি হয় আর হরিনা চিংড়ি দেশের আভ্যন্তরীর বাজারে সরবারহ করা হয়। সব মিলিয়ে সাতক্ষীরা জেলা থেকে বছরে দেড় কোটি টাকার চিংড়ি রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়।
কিন্তু চলতি মৌসুমে (২০১৮) সাতক্ষীরায় চিংড়িতে ভাইরাস ও মড়ক দেখা দেওয়ায় চাষীদের প্রায় পথে বসার উপক্রম হয়েছে। একদিকে রোগ বালায়ের প্রাদুর্ভাব, অন্যদিকে দাম কমে যাওয়ায় চিংড়ি চাষীরা দিশেহানা হয়ে পড়েছেন। এমনিক চলতি মৌসুমে ১০০ কোটি টাকার উপরে চিংড়ি মরে গেছে। ফলে জেলার ছোট বড় অসংখ্যা চিংড়ি চাষি তাদের পুজিপাট্টা হারিয়ে সর্বশান্ত হয়ে পড়েছে।
এদিকে সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ঘেরে পানি সল্পতা, পরিবেশ সম্মত না হওয়া এবং রেনু পোনা জীবানু মুক্ত না হওয়ায় এ ভাইরাস দেখা দিচ্ছে।
সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য অফিস সুত্রে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে সাতক্ষীরার ছয়টি উপজেলায় ৪৯ হাজার ১৬৩টি নিবন্ধিত ঘেরে রপ্তানিজাত বাঁগদা চিংড়ি চাষ করা হয়েছে। এরমধ্যে সাতক্ষীরা সদরে ২ হাজার ১০৫টি, তালায় ১ হাজার ২৯৫টি, দেবহাটায় ২ হাজার ৮২৯টি, আশাশুনিতে ১৩ হাজার ২১৭টি, কালিগঞ্জে ১৪ হাজার ৫৫৯টি ও শ্যামনগর উপজেলায় ১৫ হাজার ১৫৮টি ঘেরে রপ্তানিজাত বাঁগদা চিংড়ি চাষ করা হয়েছে। যার উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২৭ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন। তবে গেল মৌসুমে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৬ হাজার মেট্রিকটন।
সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার শরাফপুর গ্রামের চিংড়ি চাষী রাজ্যেস্বর দাশ জানান, ‘বিগত ৩০ থেকে ৩৫ বছর যাবৎ রপ্তানিজাত চিংড়ি উৎপাদন করেন তিনি। চলতি মৌসুমেও ২ হাজার ৫০০ বিঘা জমিতে বাঁগদা চিংড়ি চাষ করেছেন। তবে গত ১০ বছরের মধ্যে চলতি মৌসুমে চিংড়ি চাষে সর্বোচ্চ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তিনি। ’
তিনি আরো বলেন, ‘চলতি মৌসুমে উৎপাদন শুরুর পর থেকে চিংড়িতে ব্যাপকহারে মড়ক লাগে। চিংড়ির গ্রেড হওয়ার সাথে মরে সয়লাব হয়ে গেছে। এতে অন্তত প্রায় ২ কোটি টাকা। লোকসান হয়েছে তার। তাছাড়া এ বছর চিংড়ির ভাল দাম পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে তিনি ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।’
জেলার ফিংড়ি গ্রামের চিংড়ি চাষী গাল্ডেন হোসেন,জালাল উদ্দীন ও সামছুর রহমান জানান, ‘তারা প্রত্যেকে কম-বেশী চিংড়ি চাষ করেন। কিন্তু চলতি মৌসুমে ভাইরাসসহ অন্যান্য রোগ বালাইয়ে ঘেরের চিংড়ি মাছ মরে যাওয়ায় তারা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এদের মধ্যে সামছুর রহমানের প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে। একই অবস্থা চাষী গোল্ডেন ও জালাল হোসেনের।’
বাংলাদেশ চিংড়ি চাষী সমিতির সাধারণ সম্পাদক বলেন ডাক্তার আবুল কালাম বাবলা জানান, ‘চলতি মৌসুমে প্রায় দেড় হাজার বিঘার ঘেরে বাঁগদা চিংড়ি চাষ করেছেন তিনি। কিন্তু ভাইরাস আক্রান্ত হয়ে ঘেরের অধিকাংশ চিংড়ি মরে গেছে।’
তিনি বলেন, ‘ভাইরাস থেকে রক্ষা পেতে চলতি মৌসুমে আধা-নিবিড় পদ্ধতিতে আরো প্রায় ১০০ বিঘা পরিমান পুকুরে বাঁগদা চিংড়ি চাষ করেছেন। কিন্তু তাতেও মড়ক লেগে সমুদয় মাছ মরে গেছে। এতে তার এক কোটি টাকা পরিমান ক্ষতি হয়েছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘চলতি মৌসুমে জেলায় বিভিন্ন চিংড়ি ঘেরে মড়ক লেগে যে পরিমান চিংড়ি মারা গেছে তার মূল্য কমপক্ষে ১০০ থেকে ১২০ কোটি টাকা।
সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আব্দুর রব জানান, ‘সম্প্রতি আন্তর্জাতিক বাজারে চিংড়ির চাহিদা কমে যাওয়ায় ভাল দাম পাচ্ছেন না চাষীরা। দুই মাস আগে যে চিংড়ি ৯০০ থেকে ১ হাজার টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে তা এখন ৫৫০ থেকে ৬০০ টাকা দামে বিক্রি হচ্ছে। ফলে চাষী ও ব্যবসায়ী উভয় ক্ষতিগ্রস্থ।’
বাংলাদেশ চিংড়ি চাষী সমিতির সাবেক সভাপতি ডাক্তার আবতাফুজ্জামান জানান, ‘দেশের উপকুলীয় জেলা সাতক্ষীরাতে বানিজ্যিকভাবে চিংড়ি চাষ শুরু হয় মুলত ১৯৭২ সালের দিকে। এর আগে চাষীদের তেমন ভাবে আগ্রহ ছিলো না। কিন্তু ১৯৭২ সালের পর থেকে যখন এটি বিদেশে রপ্তানির চাহিদা বাড়তে লাগলো তখন থেকেই এ জেলার মানুষের মধ্যে আগ্রহ বাড়তে থাকে। যখন প্রাকৃতিক উপায়ে রেণু পোনা সংগ্রহ করে ঘেরে চাষ করা হতো তখন চিংড়িতে রোগ বালাইয়ের প্রাদুভার্ব ছিলো না। কিন্তু যখন থেকে হ্যাচারী পোনার উপর সাধারণ চাষিরা নির্ভর হলো তখন থেকেই নানা ধরণের রোগ বা ভাইরাসে আক্রান্ত হতে থাকে।
সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম জানান, ‘এ জেলায় চিংড়িতে এতো বেশী ভাইরাস দেখা দেওয়ার অনেকগুলো কারণ রয়েছে। এরমধ্যে অন্যতম কারণ হচ্ছে ঘের পানি সল্পতা ও পরিবেশ সম্মত না হওয়া। জেলার অধিকাংশ ঘেরে ৩ ফুট পরিমান পানি থাকে না। তাছাড়া অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে ঘের তৈরী করা হচ্ছে এখানে। যে রেনু পোনা ছাড়া হয় তা জীবানুমুক্ত নয়। ঘেরের তলা ঠিকমত শুকানো হয় না। যে কারণে পরিবেশ সম্মত না হওয়ায় ঘেরে মড়ক বা ভাইরাস লেগে মাছ মরে যায়। তারপরেও জেলা মৎস্য অধিদপ্তারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন এলাকায় চিংড়ি চাষীদের পরার্মশ দেওয়া হয়ে থাকে।’
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)
একই রকম সংবাদ সমূহ
১৪ জুলাই: যবিপ্রবির ল্যাবে সাতক্ষীরা জেলার ৩০ জন করোনা পজিটিভ!
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (যবিপ্রবি) জিনোম সেন্টারে ১৪ জুলাই,২০২০বিস্তারিত পড়ুন
বর্ণিল সাজে সেজেছে সাতক্ষীরার ৫৮৪টি দুর্গাপূজা মন্ডপ
সনাতন ধর্মালম্বীদের সব থেকে বড় ধর্মীয় উৎসব (দূর্গাপূজা) কে কেন্দ্রবিস্তারিত পড়ুন
‘ভোমরা স্থলবন্দরকে পূর্ণাঙ্গ বন্দর করা হবে’ : নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী
সাতক্ষীরা ভোমরা স্থলবন্দর উন্নয়ন ও পরিচালনা গতিশীলতা আনয়নের নিমিত্ত গঠিতবিস্তারিত পড়ুন