আত্মত্যাগের ৬ ডিসেম্বর : কলারোয়া হানাদার মুক্ত দিবস
প্রফেসর মো. আবু নসর
৬ ডিসেম্বর সাতক্ষীরা জেলার কলারোয়া হানাদার মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালে ৯মাস সশস্ত্র সংগ্রাম, বহু আত্মত্যাগ ও রক্তের বিনিময়ে আজকের এই দিনে কলারোয়া পাক হানাদারমুক্ত হয়। মহান মুক্তিযুদ্ধে কলারোয়ায় ২৭জন অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। কলারোয়া অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করে স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম পরিষদ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নতুন প্রজন্মকে উজ্জ্বীবিত করতে কলারোয়া হানাদার মুক্ত দিবসের ইতিহাস নি:সন্দেহে অসাধারণ ভূমিকা রাখে।
মহান মুক্তিযুদ্ধে কলারোয়া ছিলো ৮নং সেক্টরের অধীন। প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ জনাব মমতাজ আহমদ (প্রয়াত) আঞ্চলিক স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি এবং প্রবাসী সরকারের ৮নং সেক্টরের রাজনৈতিক উপদেষ্টা ছিলেন। সংগ্রাম পরিষদের সেক্রেটারি ছিলেন জনাব শেখ আমানুল্লাহ (প্রয়াত)। অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে জনাব বিএম নজরুল ইসলাম, জনাব মোসলেম উদ্দীন, জনাব হোসেন আলী, (প্রয়াত) জনাব ডা.আহমদ হোসেন খাঁন (প্রয়াত), জনাব বাবু শ্যামাপদ শেঠ (প্রয়াত), এসএম এন্তাজ আলী (প্রয়াত), এমএ করিম প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে কলারোয়া থানার সর্বত্র সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে অংশগ্রহনকারীদের মধ্যে মোসলেম উদ্দীন (পরবর্তীতে যুদ্ধকালীন কমান্ডার), আব্দুল গফফার, আব্দুর রউফ, হাবিবুর রহমান, আবুল হোসেন (১), সৈয়দ আলী গাজী, আবুল হোসেন (২), আবু বকর, জাকারিয়ারসহ অনেকের নাম বার বার উঠে আসে। পরে অবশ্য কলারোয়া থানা থেকে তৎকালীন ৩৪৩জন দামাল ছেলেরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। তাঁদের অসীম বীরত্বের পরিচয় জাতি আজো স্মরণ করে।
১৯৭১’র আগস্ট-সেপ্টেম্বরে কলারোয়ার বীর ও দূর্জয় মুক্তিযোদ্ধারা হিজলদী, মাদরা, কাকডাঙ্গা, বালিয়াডাঙ্গা, হঠাৎগঞ্জ ও অন্যান্য পাক সামরিক ঘাটির উপর উপর্যুপোরি আক্রমন চালান। পাক সেনাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি প্রচন্ড মুখোমুখি যুদ্ধও সংঘটিত হয়েছিলো।
সেসময় হঠাৎগঞ্জ থেকে পাকসেনাদের একটি বৃহৎ দল কাকডাঙ্গার উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার খবরে বালিয়াডাঙ্গা বাজারের অনতিদূরে হঠাৎগঞ্জ পুকুর পাঁড়ে অবস্থান নিয়ে ক্যাপ্টেন শফিউল্লাহর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা অতর্কিত আক্রমন চালিয়ে ২৯জন পাক সেনাকে হত্যা করে। পরবর্তীতে ৩ সেপ্টেম্বর বালিয়াডাঙ্গায় পাকসেনাদের সাথে মুক্তিবাহিনীর তুমুল মুখোমুখি যুদ্ধে ৭/৮জন পাকসেনা নিহত হয় এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা কলারোয়ার বৈদ্যপুরের জাকারিয়া, বাগাডাঙ্গার ইমাদুল, ই.বি রেজিমেন্টের লুৎফর রহমান ও শফিক চৌধুরী শহীদ হন। ১৭ সেপ্টেম্বর কাকডাঙ্গায় ফের সম্মুখ যুদ্ধে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচন্ড আক্রমনের মুখে ১৭জন পাকসেনা নিহত হয় আর বাকিরা কাকডাঙ্গা ছেড়ে দমদমায় অবস্থান নিতে বাধ্য হয়। এ যুদ্ধে নাকিলা গ্রামের হাফিজসহ কয়েকজন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। এরপর বালিয়াডাঙ্গায় ২০ সেপ্টেম্বর পুনরায় ভয়াবহ দীর্ঘক্ষনব্যাপী সম্মুখ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে বহু পাকসেনা নিহত হয়। শহীদ হন ১৭জন বীর মুক্তিযোদ্ধা। আহতও হন কয়েকজন বীরসেনানী। এর আগে ২৭আগস্ট কমান্ডার মোসলেম উদ্দীন, আব্দুল গফফার, আব্দুর রউফ, আবু বকরসহ বীর মুক্তিযোদ্ধারা হিজলদী পাকবাহিনীর ঘাটিতে আক্রমন করলে ৩০জনের মতো পাক সেনা নিহত হয়। ওই যুদ্ধে পাকবাহিনীর ঘাটির পতন হলে কলারোয়া থানার মধ্যে সর্বপ্রথম চন্দনপুর ইউনিয়ন হানাদারমুক্ত হয়। উল্লেখ্য, ওই যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের নেতৃত্বদানকারীদের অন্যতম কলারোয়া থানার কাউরিয়া গ্রামের আবু বকর পরবর্তীতে তালা থানার একটি খন্ডযুদ্ধে শহীদ হন। অক্টোবরের শেষ দিকে চন্দনপুরের গেরিলা গ্রুপ পার্শ্ববর্তী যশোরের শার্শা থানার বাগআঁচড়ায় অভাবনীয় দু:সাহসিক আক্রমন চালিয়ে ৭জন পাক রেঞ্জার ফোর্সকে হত্যা করে। পরবর্তীতে চন্দনপুরের মুক্তিফৌজ ক্যাম্পে অস্ত্র পরিষ্কার করার সময় অসাবধানতা বশত গুলি বেরিয়ে শাহেদ আলী ও নূর মোহাম্মদ শহীদ হন। তাদের কবর গয়ড়া বাজারে। এছাড়াও কলারোয়া ফুটবল মাঠের দক্ষিন পাশে, উত্তর মুরারীকাটির পালপাড়া, সোনাবাড়িয়া, বামনখালিসহ বিভিন্ন স্থানে শহীদদের কবর ও গণকবর রয়েছে।
এভাবে একের পর এক সফল অপারেশনের মধ্য দিয়ে অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধারা বিজয়ের প্রত্যাশায় পাক বাহিনীর কবল থেকে কলারোয়া’কে মুক্ত করেছিলেন ৭১’র ৬ ডিসেম্বর।
ইতিহাসে কলারোয়ার প্রথম শহীদ মাহমুদপুর গ্রামের গাজী আফসার উদ্দীন। ৩০ এপ্রিল পাকসেনাদের গুলিতে শহীদ হন তিনি।
জানা যায়- স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্তিমলগ্নে এসে ৬ ডিসেম্বর কলারোয়া পাক হানাদার মুক্ত হওয়ার দিনে গয়ড়া থেকে যুদ্ধকালীন কমান্ডার মোসলেম উদ্দীনের নেতৃত্বে, খোঁরদো থেকে আব্দুল গফফারের নেতৃত্বে ও বালিয়াডাঙ্গাসহ পার্শ্ববর্তী সীমান্ত এলাকা থেকে ক্যাপ্টেন শফিউল্লাহ’র নেতৃত্বে সঙ্গীয় বীর মুক্তিযোদ্ধারা কলারোয়া সদরে উপস্থিত হন। ডা.আবুল হাসনাতের উপস্থিতিতে বীর সেনানীরা ও মুক্তিকামী জনতা কলারোয়া থানা ভবন চত্বরে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তোলন করেন। তাই ৬ ডিসেম্বর দিবসটি কলারোয়াবাসীর জন্য ও কলারোয়ার ইতিহাসে খুবই আনন্দ ও গর্বের দিন।
লেখক:
প্রফেসর মো. আবু নসর
অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ, কলারোয়া সরকারি কলেজ, সাতক্ষীরা।
সাবেক কলেজ পরিদর্শক, যশোর শিক্ষা বোর্ড।
সাবেক কলেজ পরিদর্শক (অতিরিক্ত দায়িত্বে), বরিশাল শিক্ষা বোর্ড।
সাবেক ডেপুটি রেজিস্ট্রার, নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)
একই রকম সংবাদ সমূহ
১৪ জুলাই: যবিপ্রবির ল্যাবে সাতক্ষীরা জেলার ৩০ জন করোনা পজিটিভ!
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (যবিপ্রবি) জিনোম সেন্টারে ১৪ জুলাই,২০২০বিস্তারিত পড়ুন
‘প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে সরকার কাজ করছে’: লুৎফুল্লাহ এমপি
সাতক্ষীরা-১ আসনের সংসদ সদস্য এড.মুস্তফা লুৎফুল্লাহ বলেছেন- ‘করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবেও উন্নয়নবিস্তারিত পড়ুন
কলারোয়ার দমদম বাজার মার্কেটের বহুতল ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন
কলারোয়ার দমদম বাজার মার্কেটের বহুতল ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন করা হয়েছে।বিস্তারিত পড়ুন