৯ বীর শহীদের কলারোয়ার পালপাড়ার বধ্যভূমির ইতিকথা…
মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা প্রাপ্তির ৪৮তম বছরে এসে মনে পড়ে কলারোয়ার মুরারীকাটি কুমারপাড়ার সেই দুঃসহ স্মৃতির কথা।
১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে নরপশু পাক-হানাদার বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়েছিল নয়টি তাজা প্রাণ। কলারোয়াবাসী প্রত্যক্ষ করেছিল পৌরসদরে বেত্রবতী নদীর পূর্ব পার্শ্বে অবস্থিত মুরারীকাটি পালপাড়ায় এক নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। বিভৎস সে দৃশ্য।
ইতোমধ্যে ৪৮ তম বিজয় দিবস পালন করেছে বাঙালি জাতি। যে স্বাধীনতা অর্জনে আত্মাহুতি দিতে হয়েছে প্রায় ৪০ লাখ মানুষকে। সম্ভ্রম হারাতে হয়েছে প্রায় ২ লাখ বঙ্গললনাকে। সেই মৃত্যু কাফেলার অনন্ত যাত্রার পথিক মুরারীকাটি কুমারপাড়ার এই ৯ জন কুমারও।
উপজেলার সদর হতে পূর্বমুখে যে রাস্তা সোজা চলে গেছে বেত্রবতী নদীর ওপর পাকা ব্রিজ হয়ে পার্শ্ববর্তী কেশবপুর উপজেলার দিকে সেই রাস্তায় পাকা ব্রিজ পার হয়েই ডান পাশে এই সুবৃহৎ কুমারপাড়ার অবস্থান। মুক্তিযুদ্ধ তখন রীতিমত উত্তাল, জীবন দেয়া-নেয়ার মহোৎসবে বাংলার দামাল ছেলেরা রণাঙ্গনে লড়ছে তাদের জীবনের শ্রেষ্ঠতম লড়াই। দেশের অন্যান্য স্থানের মত উপজেলা কলারোয়াও তখন আতংকের জনপদ। বিভীষিকার রাজত্ব কায়েম করে রেখেছিল বর্বর পাকহানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসর জামায়াত ও ইসলামী ছাত্রসংঘ।
মুক্তিযুদ্ধের সাথে প্রত্যক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রায় সবাই তখন সীমান্ত অতিক্রম করে আশ্রয় নিয়েছে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে। কুমারপাড়াতেও চলছিল তোড়জোড়। সিদ্ধান্ত ছিল দুই/এক দিনের মধ্যেই তারাও আবাল্য ধুলি মাখা স্মৃতি বিজড়িত স্বদেশ ছেড়ে পাড়ি জমাবে ভারতে। কিন্তু কিভাবে কি হলো তা সঠিক রুপে জানা যায় না। তবে স্বার্থাম্বেষী মহল যেভাবেই হোক জেনে ফেলে তাদের সিদ্ধান্তের কথা। হানাদার বাহিনীর পদলেহনকারী এদেশীয় কিছু কুলাঙ্গার বিভিন্ন প্রকার ছলচাতুরি করে তাদের যাত্রা বিলম্বিত করে দেয়।
এলো সেই ভয়াল দিন-১৬বৈশাখ, শুক্রবার, ১৩৭৮ বাঙলা সন। দুপুর ২.৩০মিনিটের দিকে বিনা মেঘে বজ্রপাত হলো যেন কুমারপাড়ায়। কলারোয়ার তৎকালীন মুরারীকাটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের প্রত্যক্ষ সহায়তায় অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র সজ্জিত পাকসেনারা পৈশাচিক হামলা চালায় কুমারপাড়ায়। নিরীহ, নির্দোষ কুমারদের রক্তস্রোতে ভেসে যায় কুমারপাড়া। তাদের নির্মম, নারকীয় গণহত্যার শিকার হন-বৈদ্যনাথ পাল (৪৫), নিতাই পাল (৪০), গোপাল পাল (৪২), সতীশ পাল (৪৫), রাম চন্দ্র পাল (৪০), বিমল পাল (৪২), রঞ্জন পাল (৪০), অনিল পাল (৪৫) ও রামপদ পাল (৪২)। শিবু পাল মারাত্মক ভাবে বেয়োনেট বিদ্ধ হয়েও জীবিত ছিল। রঞ্জন পালও জীবিত ছিল- সংঘটিত ঘটনার প্রায় ১ ঘন্টা পর পুনরায় ফিরে এসে বর্বর পাকসেনারা তার মৃত্যু নিশ্চিত করে। ততক্ষণে বেয়োনেট বিদ্ধ ও পায়ে গুলি লাগা মারাত্মকভাবে আহত শিবু পাল ও ত্রৈলক্ষ্য পালকে সরিয়ে ফেলা হয়েছিল ভিন্ন ভিন্ন নিরাপদ স্থানে।
ঘটনার পরপরই ত্রৈলক্ষ্য পালকে টালি পোড়াবার পন ভাটিতে ঢুকিয়ে রাখে তুলসীডাঙ্গা গ্রামের বিজি মাওলা ও পার্শ্ববর্তী এক গ্রামবাসী।
পরে শনিবার রাতে শ্রীপতিপুর গ্রামের ধাবক পাড়ার আব্দুর রউফ (ইউপি সদস্য) ত্রৈলক্ষ্য পালকে সংগোপনে বের করে একই গ্রামের শেখ রাশেদের বাড়ির পাশে এক অজ্ঞাত স্থানে লুকিয়ে রাখে। এখান থেকে আব্দুর রউফ মেম্বার, শেখ রাশেদ ও পাশ্ববর্তী হাজী আব্দুল ওয়াহেদ অত্যন্ত সংগোপনে তার চিকিৎসা সেবা চালিয়ে যান।
৬দিন পর গদখালি গ্রামের টেটের ঘোড়ার গাড়িতে করে ঝিকরা গ্রামের মেহের আলী (উভয়ই মৃত) চুপিসারে ত্রৈলক্ষ্য পালকে সীমান্ত অতিক্রম করিয়ে ভারতের হাকিমপুর বাজারে নিয়ে যায়। সেখানে মুক্তিযুদ্ধের ৮ নম্বর সেক্টর এলাকার অন্যতম সংগঠক কলারোয়া হাইস্কুলের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক শেখ আমানুল্লাহর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ত্রৈলক্ষ্য পালকে ভর্তি করা হয় সাড়াপোল হাসপাতালে। তার সাথে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া স্বজনদের সাথে সংযোগও স্থাপিত হয় শেখ আমানুল্লাহর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায়। অপর আহত শিবু পাল চিকিৎসার জন্য ভর্তি হন বনগাঁ সদর হাসপাতালে।
উল্লেখ্য, একই দিনে সকালের দিকে কলারোয়ার তৎকালীন গোপীনাথপুর ইউপি’র মাহমুদপুর গ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা আফছার আলী (৪৮) হানাদার বাহিনীর হাতে প্রথম শহীদ হন। মৃতেরা কথা বলেনা, তা’না হলে এ ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী দিতে পারতেন ঝাউডাঙ্গার গোবিন্দকাটি গ্রামের আকরাম আলী (মৃত) যিনি ছিলেন আফছার আলীর অভিন্ন হৃদয় বন্ধু এবং তাঁর হত্যাকান্ডের প্রত্যক্ষদর্শী।
যাই হোক, কুমারপাড়ার এই হৃদয়বিদারক ঘটনার জন্য দায়ী নায়কদের মধ্যে অনেকেই মৃত। ইদ্রিস আলী খান ধরা পড়ে কলারোয়া হানাদার মুক্ত দিবস ৬ ডিসেম্বর দুপুরে। যুদ্ধকালীন উপজেলা কমান্ডার ও খোরদো পাকূড়িয়া গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধার বাহিনী তাকে বেয়োনেট চার্জ করে লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেন।
কুমারপাড়ার বাঁধানো গণকবরটির ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেছিলেন যুদ্ধকালীন কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মোসলেম উদ্দীন। উপজেলার জালালাবাদ গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা মিজানুর রহমান, নিজস্ব এবং সরকারি কিছু অর্থানুকুল্যে ৯ শহীদের বধ্যভূমি পাকা দেয়াল দিয়ে ঘেরা ও পাথরে খোদিত রয়েছে শহীদদের নাম। সে সময় শহীদদের স্বজনদের পাশে থেকে প্রত্যক্ষ সহায়তা করেছিলেন কলারোয়া কলেজের তৎকালীন ইংরেজী বিষয়ের অধ্যাপক নিমাই মন্ডল, অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক জাভিদ হাসান, এড শেখ কামাল রেজাসহ এলাকার আরও অনেক মুক্তিকামী মানুষ।
পাশেই রাধা গোবিন্দের মন্দির। প্রতি বছর ১৬ বৈশাখ শহীদদের সস্তান ও স্বজনরা তাঁদের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করে এখানে পালন করে বিভিন্ন মঙ্গলাচার ও নাম সংকীর্তন অনুষ্ঠান।
তাদের বেদনা বিধুর মুখচ্ছবি আর অনুচ্চারিত ভাষা বার বার মনে করিয়ে দেয়-এই বাংলায় সকল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে কী? এলাকার বহুল আলোচিত এ গণহত্যার দায়ে শহীদদের স্বজনরা স্থানীয় কোন পাকিস্তানী দোসরের বিরুদ্ধে কোন মামলা করতে পারেননি নিরাপত্তাজনিত কারণে এমনটিই বললেন সে সময়ে পাকি হায়েনাদের কবল থেকে বেঁচে যাওয়া ত্রৈলক্ষ্য পাল।
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)
একই রকম সংবাদ সমূহ
১৪ জুলাই: যবিপ্রবির ল্যাবে সাতক্ষীরা জেলার ৩০ জন করোনা পজিটিভ!
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (যবিপ্রবি) জিনোম সেন্টারে ১৪ জুলাই,২০২০বিস্তারিত পড়ুন
‘প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে সরকার কাজ করছে’: লুৎফুল্লাহ এমপি
সাতক্ষীরা-১ আসনের সংসদ সদস্য এড.মুস্তফা লুৎফুল্লাহ বলেছেন- ‘করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবেও উন্নয়নবিস্তারিত পড়ুন
কলারোয়ার দমদম বাজার মার্কেটের বহুতল ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন
কলারোয়ার দমদম বাজার মার্কেটের বহুতল ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন করা হয়েছে।বিস্তারিত পড়ুন