পড়াশোনার দায়িত্ব নিলেন প্রবাসী বাঙালি
বনানীর ‘হিরো’ সেই নাঈমের ছবি ভাইরাল, হতে চায় পুলিশ অফিসার
দাউ দাউ করে জ্বলছে এফআর টাওয়ার, আগুন নেভাতে প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা। ভয়াবহ ওই পরিস্থিতিতে কয়েক হাজার উৎসুক জনতা যখন হা করে তাকিয়ে ছিলেন জ্বলন্ত ভবনের দিকে, কেউ কেউ যখন মোবাইলে ছবি তোলায় ব্যস্ত ছিলেন, ঠিক তখন ফায়ার সার্ভিসের ফাটা পাইপে পলিথিন জড়িয়ে পানি আটকানোর চেষ্টা করতে দেখা যায় এক শিশুকে।
বৃহস্পতিবার ঢাকার বনানীতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের সময় নাঈম ইসলাম নামের ওই বালকের ছবি ছড়িয়ে পড়েছে ফেইসবুকে। অনেকেই শিশুটিকে প্রশাংসায় ভাসিয়ে সেই ছবি শেয়ার করেন।
সামাজিক যোগযোগের মাধ্যমে ‘হিরো’ হয়ে ওঠা নাঈম শুক্রবার আবারও বনানীর সেই পোড়া ভবনের সামনে এলে অনেকেই তাকে ধন্যবাদ জানান। বুদ্ধিদীপ্ত কাজের জন্য তাকে বুকে জড়িয়ে ধরেন কেউ কেউ।
পঞ্চম শ্রেণি পড়ুয়া নাঈম সাংবাদিকদের বলে, “আমি দুপুরবেলা এসে দেখি এখানে আগুন লেগেছে, ফায়ার সার্ভিস অনেক কষ্ট করে আগুনটা নেভাতে চাইছে। আমি দেখি পাইপটা ফাটা, সেজন্য আমি পাইপটা চাপ দিয়ে ধরে রাখলাম, যেন পানিটা ভালোমত কাজে লাগে, আগুন নিভে যায়।”
পলিথিন কোথায় পেয়েছ- সেই প্রশ্নে নাঈম জানায়, একজন এসে পলিথিন দিয়ে গেলে সেটা দিয়েই ফাটা পাইপ চাপ দিয়ে ধরে রাখে সে।
সবাই যখন ঘুরছিল, এই শিশু কেন ফাটা পাইপের পানি বন্ধের চেষ্টা করতে গেল?
নাঈমের উত্তর, “আমার মনে হচ্ছিল শতশত লোক মারা যাবে। আমি যদি পাইপটা ধরে রাখতে পারি তবে ফায়ার সার্ভিস পানিটা অগুন নেভানোর কাজে লাগিয়ে মানুষকে বাঁচাতে পারবে।”
রাজধানীর কড়াইল বৌ বাজারে বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকে নাঈম। বাবা ডাব বিক্রি করেন। আর তার মা মেসে রান্নার কাজ করেন। ছোট এক বোন আছে তার। তাদের গ্রামের বাড়ি বরিশালে।
বড় হয়ে কী হতে চাও- এই প্রশ্ন করতেই নাঈম জানালো, সে পুলিশ অফিসার হতে চায়।
“পুলিশ ফায়ার সার্ভিসকে অনেক সহযোগিতা করেছে। আর লোকজনকে দূর পাঠিয়ে দিয়েছে যেন তাদের ক্ষতি না হয়।”
পড়াশোনার দায়িত্ব নিলেন প্রবাসী বাঙালি
নাঈমকে পাঁচ হাজার ডলার ও পড়াশোনার দায়িত্ব নেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ওমর ফারুক সামি। রাজধানীর বনানীর কামাল আতাতুর্ক এভিনিউতে আকাশচুম্বী ফারুক রূপায়ণ (এফ.আর) টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে পাইপ ধরে রাখা একটি শিশুর ছবি। অধিকাংশ মানুষ যেখানে ছবি তুলতে ব্যস্ত ছিল সেখানে যেন ব্যতিক্রম শিশুটি।
অনেকে ফেসবুকে শিশুটির ছবি শেয়ার দিয়ে তার কাজের প্রশংসা করেছেন। শিশু নাঈমের এই মানবিক কাজে খুশি হয়ে তাকে উপহার স্বরূপ পাঁচ হাজার ডলার প্রদানের ঘোষণা দিলেন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ওমর ফারুক সামি। পাশাপাশি তার যাবতীয় পড়ালেখার দায়িত্ব গ্রহণেরও কথা জানালেন তিনি।
সিলেটের গোপালগঞ্জ উপজেলার ওমর ফারুক সামি জানান, ’আমি নাঈমের কাজে খুবই খুশি হয়েছি। নাঈম খুব কষ্ট করে লেখাপড়া করছে, সে পুলিশ অফিসার হতে চায়। তার ইচ্ছেপূরণ করতে আজ থেকে তার পড়ালেখার দায়িত্ব নিচ্ছি। পর্যায়ক্রমে তার উপহারের পাঁচ হাজার ডলারও প্রদান করব।’ এই বিষয়ে নাঈমের পরিবারের সঙ্গে ইতিমধ্যে আলাপ হয়েছে বলেও জানান এই যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী।
নাঈম কড়াইল বস্তির বড় নৌকাঘাট আরবার স্লাম আনন্দ স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়াশোনা করে। একই স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ছে নাইমের ছোট বোন। নাঈমের মা নাজমা বেগম স্বপ্ন দেখেন তার ছেলেমেয়েরা তার মতো কষ্টের জীবন কাটাবে না। সমাজের আর সব সাধারণ মানুষের মতো ভালো স্কুলে-কলেজে পড়াশোনা করে সম্মানের জীবন কাটাবে। স্বপ্ন থাকলেও দারিদ্র্যের কষাঘাত বাধা হয়ে দাঁড়ায় স্বপ্নগুলোর মাঝে।বৌবাজারের আনন্দ স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ুয়া নাইম অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় পাইপের লিকেজে পলিথিন পেচিয়ে ধরে বসে ছিল।
বৃহস্পতিবার বনানীতে আগুনকবলিত এফআর টাওয়ার ঘিরে হাজারো মানুষের হাহাকার, আর্তনাদ। কারও সহকর্মী আটকা পড়েছে জ্বলন্ত ভবনে, কারও বা স্বজন-পরিচিত। কারও হয়তো পরিচিত কেউ নেই, তবু তার মধ্যেও হাহাকার। এক অশ্রুসিক্ত আবেগময় পরিবেশ। অগ্নিকাণ্ডে আটকে পড়া মানুষদের উদ্ধার করতে প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছে ফায়ার সার্ভিসের ২১টি ইউনিটের ১৩৩ জন কর্মী। আগুনের ভয়াবহতা যখন প্রতিকূলে তখন সেনাবাহিনী, নৌ-বাহিনী, বিমানবাহিনীর সদস্যরাও যোগ দেন উদ্ধারকাজে। সাহায্যে এগিয়ে আসে স্থানীয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররা। মানুষকে বিপদের মুখে দেখে নিজের সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করছে স্থানীয় অনেকেই।
এগিয়ে এসেছিল ১৪ বছরে এক বালকও। ছোট মনে হয়তো তাড়না বোধ করছিল বিপদে পড়া মানুষের জন্য কিছু করার। কিন্তু কী করবে সে, তাকে তো কেউ কাছাকাছি ঘেঁষতেই দেবে না। তারপর যা করল, তা তাকে বীর বানিয়ে দিয়েছে। এই বালকের নাম নাঈম। তার একটি ছবি সামাজিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়।
ছবিতে দেখা যায়- নাঈম এফআর টাওয়ারের আগুন নেভানোরত ফায়ার সার্ভিসের পানির পাইপের ফাটা অংশের ওপর পলিথিন পেঁচিয়ে তার ওপর সর্বশক্তি দিয়ে আটকে রেখেছে, যাতে ঠিকমতো পানি সরবরাহ হয় অগ্নিনির্বাপন মেশিনে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছবিটি আসার পর কিছু সময়ের মধ্যেই তা ছড়িয়ে পড়ে। মাত্র ১৪ বছর বয়সের বালকের এই প্রাণপ্রাণ চেষ্টাকে সাধুবাদ জানিয়েছেন সব পর্যায়ের মানুষ। কেউ কেউ তাকে দিয়েছেন বীরের খেতাব।
ফাটা পাইপ দিয়ে পানি বেরিয়ে যাওয়ার কারণে দমকল কর্মীরা ঠিকমতো পানি পাচ্ছেন না এটেই মাথায় এসেছিল নাঈমের। আর কোনো কোনো কিছু ভাবেনি সে। নাঈম জানায়, যখন ফায়ার সার্ভিসসহ অন্যান্য সংস্থা ও সাধারণ মানুষ আগুন নেভাতে কাজ করছিল, তখন বারবার পানি শেষ হয়ে যাচ্ছিল। ফায়ার সার্ভিসের পানির পাইপ এক জায়গায় ফাটা ছিল। ফাটা অংশ দিয়ে অনেক পানি নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। তখন পাশ থেকে একটি পলিথিন নিয়ে পাইপের ফাটা অংশটি চেপে ধরে সে। নাঈম বলে, ‘আমি আর কোনো কিছু না ভেবেই এটা করেছি। আমি দেখতে ছিলাম পানি বের হচ্ছিল। আমি পাইপটারে পলিথিন দিয়ে চেপে ধরেছি, যাতে পানি বাইরে নষ্ট না হয়।’
মা আর এক বোনের সঙ্গে ঢাকার কড়াইল বস্তিতে থাকে নাঈম। তার বাবার নাম রুহুল আমীন। বাবা থাকলেও তাদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই বলে জানান নাঈমের মা। নাঈমের মা নাজমা বেগম জানান, গত ৫-৬ বছর ধরে নাঈমের বাবার সঙ্গে তাদের কোনো যোগযোগ নেই। নিজে অন্যের বাসায় কাজ করে অতি কষ্টে পরিবারের খাওয়া-থাকার খরচ ব্যবস্থা করেন। নাজমা বেগম বলেন, ‘ওর বাবার লগে আমগো যোগাযোগ নাই অনেক বছর। ৫-৬ বছর হইছে। নিজে বাসা-বাড়িতে কাম কইরা চলি।‘ দারিদ্র্য যেখানে পিছু ছাড়ছে না, যেখানে সন্তানদের ভালো জায়গায় পড়াশোনা করানো স্বপ্ন বলে জানান নাঈমের মা। বলেন, ‘যে টাকার কাম করি তা দিয়ে চলাও কষ্ট। পোলাপানগুলারে ভালো জাগায় পড়ামু ক্যামনে?’
ভিডিও দেখতে ক্লিক করুন:
Posted by Rahman Shelley on Friday, March 29, 2019
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)
একই রকম সংবাদ সমূহ
‘ভোমরা স্থলবন্দরকে পূর্ণাঙ্গ বন্দর করা হবে’ : নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী
সাতক্ষীরা ভোমরা স্থলবন্দর উন্নয়ন ও পরিচালনা গতিশীলতা আনয়নের নিমিত্ত গঠিতবিস্তারিত পড়ুন
টিকাদানের সাফল্যে ‘ভ্যাকসিন হিরো’ পেলেন প্রধানমন্ত্রী
টিকাদানের সাফল্যে ‘ভ্যাকসিন হিরো’ পেলেন প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশে টিকাদান কর্মসূচি একটিবিস্তারিত পড়ুন
সর্বজনীন স্বাস্থ্য কর্মসূচির অগ্রগতি ত্বরান্বিত করার আহ্বান
জাতিসংঘের ৭৪তম সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে নিউ ইয়র্কে এসেবিস্তারিত পড়ুন