চলেই গেলো সাতক্ষীরার মুক্তামনি, দাদার কবরের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত
রক্তনালীতে টিউমার আক্রান্ত সাতক্ষীরার বহুল আলোচিত সেই শিশু মুক্তামনি (১২) অবশেষে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে হেরে গেছে। বুধবার সকাল ৭ টা ২৮ মিনিটে সে তার নিজ বাড়ি সাতক্ষীরা সদর উপজেলার কামারবাসা গ্রামে মারা যায় (ইন্না—-রাজিউন)।
সাতক্ষীরা জেলা শহর থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরে ওই কামারবাসা গ্রামটি। ওই গ্রামের মুদি ব্যবসায়ী ইব্রাহিম হোসেনের দুই যমজ মেয়ে হীরামণি ও মুক্তামণি। জন্মের দেড় বছর পর থেকে মুক্তামণির সমস্যা শুরু হয়। প্রথমে ডান হাতে ছোট একটি টিউমারের মতো হয়। ছয় বছর বয়স পর্যন্ত টিউমারটি তেমন বড় হয়নি। কিন্তু পরে তা ফুলে কোলবালিশের মতো হয়ে পড়লে মুক্তামণি বিছানায় বন্দী হয়ে পড়ে। সেটি দিন দিন বড় আকার ধারণ। কয়েক বছর আগে থেকে তার আক্রান্ত ডান হাতটি একটি গাছের ডালের আকার ধারন করে এবং ওই হাতে শুরু হয় পঁচন। সেখানে বড় বড় পোকা জম্মায়। চারি দিকে দুর্গন্ধ ছড়াতে থাকে।
গত বছর জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে বিভিন্ন গণমাধ্যমে মুক্তামনির বিরল রোগে আক্রান্ত হওয়ার খবর প্রচার হয়। এক পর্যায়ে মুক্তামনির বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টিগোচর হলে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে তাকে ২০১৭ সালের ১১ জুলাই ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়। সেখানে প্রধানমন্ত্রীর তত্ত্বাবধানে তার চিকিৎসা চলছিল। টানা ছয় মাসের চিকিৎসায় খানিকটা উন্নতি হওয়ায় ২০১৭ সালের ২২ ডিসেম্বর মুক্তামনিকে এক মাসের ছুটিতে তার গ্রামের বাড়ি পাঠানো হয়।
গ্রামের বাড়িতে আসার পর থেকে তার অবস্থা ক্রমেই অবনতি হতে থাকে। তার দেহে নতুন করে পচন ধরে। ক্ষতস্থানে বড় বড় পোকা জন্মায়। এমনকি রক্তও ঝরতে থাকে। তার হাত-পা সরু হতে শুরু করে। দিনে একবার করে তার হাতে ড্রেসিং করা হতো।
মুক্তামনির বাবা ইব্রাহিম হোসেন বলেন, বুধবার ওই সময় তারা বুঝতে পারে মুক্তামনি না ফেরার দেশে চলে গেছে। মৃত্যুে কিছু আগে মুক্তামনি তার পিতার কাছে পানি খেতে চাই। পানি খাওয়ানোর কিছু পরেই সে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
২০১৭ সালে ঢাকায় যাওয়ার আগে সাতক্ষীরাসহ বিভিন্ন জায়গায় নানা চিকিৎসা চলে। তবে ভালো হয়নি বা ভালো হবে, সে কথা কেউ কখনো বলেননি। গণমাধ্যমকর্মীদের মাধ্যমে খবর প্রকাশ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তুমুল আলোচনায় আসে মুক্তামণি।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে মুক্তামণিকে ভর্তি করা হয়েছিল। অস্ত্রোপচারের আগে ও পরে বার্ন ইউনিটের কেবিনে ছিল ছয় মাস। গত বছরের ১২ আগস্ট তার হাতে অস্ত্রোপচার হয়। তার ডান হাত থেকে প্রায় তিন কেজি ওজনের টিউমার অপসারণ করেন চিকিৎসকেরা। পরে দুই পায়ের চামড়া নিয়ে দুই দফায় তাঁর হাতে লাগানো হয়। তবে সাময়িকভাবে হাতের ফোলা কমলেও তা সম্প্রতি আগের চেয়েও বেশি ফুলে গিয়েছিল। রক্ত জমতে থাকে ফোলা জায়গায়। আর ড্রেসিং করতে কয়েক দিন দেরি হলেই হাত থেকে দুর্গন্ধ বের হতো। আগের মতো হাতটিতে পোকাও দেখা যায়।
মুক্তামণির বাবা ইব্রাহিম আরো বলেন, মুক্তামণির ডান হাতের অবস্থা খারাপ দেখে ১৫ দিন আগে ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ণ ইউনিটের প্রধান ডা. সামন্ত লাল সেনের সঙ্গে মোবাইলে কথা বলেন। এ সময় তিনি (ডাঃ) মুক্তার দুটি ছবি পাঠানোর কথা বলেন। ছবি দেখে তার হাতের অবস্থা খারাপ বলে জানান ডা. শারমিন সুমি। এরপর গত বুধবার সামন্ত লাল সেন ফোন করে মুক্তামণির খোঁজ খবর নিয়ে রোজার পরে তাকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছিলেন। মুক্তামণির অবস্থার অবনতির পাশাপাশি জ্বর এলে তিনি গত মঙ্গলবার আবার ডা: সামন্ত লাল সেনের সঙ্গে কথা বলে তাকে বিস্তারিত জানান।
সাতক্ষীরার সিভিল সার্জন তওহীদুর রহমান বলেন, ডা: সামন্ত লাল সেন তাকে জানান মুক্তামনির অবস্থার অবনতি হয়েছে। অবস্থার অবনতি হয়েছে শুনে গত মঙ্গলবার দুপুরে তিনি সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা: ফরহাদ জামিল ও অর্থোপেডিক্স বিশেষজ্ঞ ডা: মো. হাফিজুল্লাহকে মুক্তামণির বাড়িতে পাঠান।
ডা: ফরহাদ জামিল বলেন, তিনি ও ডা: হাফিজুল্লাহ মঙ্গলবার দুপুরে মুক্তামণির বাড়িতে গিয়েছিলেন। মুক্তামণির শরীরে তখন জ্বর ছিল। রক্তশূন্যতায় ভুগছিল সে। হাতের ক্ষত আরও বেড়ে গিয়েছিল। দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছিল। তার রোগ শরীরে ছড়িয়ে পড়েছিল। ভালো করে সে কথা বলতে পারছিল না। বিষয়টি তাঁরা ডা. সামন্ত লাল সেনকে বিস্তারিত জানান। তিনি বলেন, আমরা ডা: সামন্ত লাল সেনের সাথে আলাপ আলোচনা করে কিছু ওষধ লিখে দিয়ে আসি। অসুস্থ মুক্তামনিকে কেনো সাতক্ষীরা সদর হাপাতাল বা ঢাকায় পাঠানো হলো না জানতে চাইলে ডা: ফরহাদ জামিল জানান, মুক্তামণি ও তার বাবা ইব্রাহিম হোসেন আর ঢাকায় যেতে চাচ্ছিলেন না।
মুক্তামণির মা আসমা খাতুন জানান, বুধবার সকালে মুক্তামণি তাকেও কাছে ডাকেন। তার ভালো লাগছে না বলে জানায়। সাতটা ২৫ মিনিটের দিকে সে পানি চায় তার কাছে। এরপর পানি পান করার কিছক্ষণ পরেই তার সমন্ত শরীর ঠান্ডা হয়ে আসে এবং মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
তিনি আরো বলেন, আমরা প্রথমে ভেবে ছিলাম মুক্তামনি পানি পানের পর ঘমিয়ে পড়েছে। কিন্তু তার গায়ে হাত দিয়ে দেখি সমন্ত শরীর ঠান্ডা বরফের মতো। পরে ডাক্তারকে খবর দিলে ডা: ফরহাদ জামিল তাদের বাড়িতে আসে এবং মারা যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
মুক্তামনির যমজ বোন হিরামনি। বোনের মারা যাওয়াটা সে যেনো কোন ভাবেই মেনে নিতে পারছে না। তার আহাজারিতে এলাকার বাতাস ভারী হয়ে যায়। হিরামনি বলেন, মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত মুক্তা তাদের সাথে কষ্ট হলেও কথা বলেছে। খাবার পানি চেয়েছে। পানি খাওয়ার পর সেই যে ঘুমালো আর চোখ খুলেনি।
মুক্তামনির মৃত্যুতে পুরো কামারবাসা গ্রামে শোকের ছায়া নেমে আসে। নির্বাক হয়ে পড়েছেন মুক্তামনির মা। থামছে না বাবা ইব্রাহিম হোসেনের চোখের জল। হারানোর বেদনায় কাতর ছোট বোন হিরামনি। মা বার বার জ্ঞান হারিয়ে ফেলছিল। মা ,বোন, স্বজনদের আত্মনাদে এলাকার বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। তার মৃত্যুর খবর জানার পর ওই এলাকায় শত শত মহিলা, পুরুষ তাকে একনজর দেখার জন্য ছুটে আসে। এমনকি খবর পেয়ে সাতক্ষীরা পুলিশ সুপার সাজ্জাদুর রহমান, সিভিল সার্জন ডা: তওহীদুর রহমান, সাতক্ষীরা সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান বাবু সেখানে যান।
বুধবার জোহর নামাজের পর বেলা আড়াইটার দিকে দক্ষিণ কামারবাসা জামে মসজিদের পাশ্ববর্তী মাঠে জানাজার নামাজ শেষে পারিবারিক কবর স্থানে মরহুম দাদার কবরের পাশেই মুক্তাকে দাফন করা হয়েছে। এর আগে দু’দফা মুক্তামনিকে গোসল করানো হয়। প্রথম দফায় গোসলের পর তার কাফনের কাপড় রক্তে ভিজে নষ্ট হয়ে যায়। পরে আবারও তাকে গোসল করানো হয়। তার জানাজার জানাজে এলাকার শত শত মানুষ শরীক হন।
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)
একই রকম সংবাদ সমূহ
১৪ জুলাই: যবিপ্রবির ল্যাবে সাতক্ষীরা জেলার ৩০ জন করোনা পজিটিভ!
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (যবিপ্রবি) জিনোম সেন্টারে ১৪ জুলাই,২০২০বিস্তারিত পড়ুন
বর্ণিল সাজে সেজেছে সাতক্ষীরার ৫৮৪টি দুর্গাপূজা মন্ডপ
সনাতন ধর্মালম্বীদের সব থেকে বড় ধর্মীয় উৎসব (দূর্গাপূজা) কে কেন্দ্রবিস্তারিত পড়ুন
‘ভোমরা স্থলবন্দরকে পূর্ণাঙ্গ বন্দর করা হবে’ : নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী
সাতক্ষীরা ভোমরা স্থলবন্দর উন্নয়ন ও পরিচালনা গতিশীলতা আনয়নের নিমিত্ত গঠিতবিস্তারিত পড়ুন