চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্তরা হারাচ্ছেন ‘কর্মক্ষমতা’
চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্তরা ৫/৬দিন পর এই জ্বর থেকে সেরে উঠলেও হাঁটু, আঙুল ও গিঁটের ব্যথা থেকে মুক্তি পাচ্ছে না। এই ব্যথা এতই তীব্র যে, আক্রান্তরা স্বাভাবিকভাবে আর উঠতে-বসতে ও চলাফেরাও করতে পারছেন না। তারা দীর্ঘক্ষণ যেমন বসে কাজ করতে পারছেন না, তেমনি পারছেন না স্বাভাবিকভাবে কোনও কিছু হাত দিয়ে ধরতেও। ফলে তারা স্বাভাবিক ক্ষমতা হারাচ্ছেন বলে মন্তব্য করেছেন চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত কয়েকজন রোগী ও সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক।
কলাবাগানের বাসিন্দা নুসরাত সুলতানা বলেন, ‘১২ ফেব্রুয়ারি প্রথমে আক্রান্ত হন আমার শাশুড়ি। এরপর আমি ও মেয়ে। আমি এখনও স্বাভাবিক কিছু করতে পারি না, হাত দিয়ে কিছু ধরতে কষ্ট হয়।’
গণমাধ্যমকর্মী সেবিকা দেবনাথ চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার পর যেন ছোটবেলায় ফিরে গেছেন। জানালেন, ‘ছোট বেলায় যেমন দুই হাতে গ্লাস বা মগ ধরতে হতো, দাঁত ব্রাশের সময় ব্রাশটা দুই হাতে ধরতে হতো, কামড় দিয়ে বাদামে খোসা ছাড়াতে হতো, রিকশা/বাসে ওঠা-নামার সময় কারও হাত ধরতে হতো, পড়ে যাওয়ার ভয়ে ধীরে-ধীরে হাঁটতে হতো, আটকে যাওয়ার ভয়ে টয়লেটে গেলে বাবা-মায়ের কথামতো দরজা লক না করে চাপা দিয়ে রাখতে হতো, এখনও ঠিক সে অবস্থা।’
সেবিকা বলেন, ‘আমি হয়তো কয়েকদিন পর অফিসে এসে চেয়ারে বসে কাজ করতে পারছি। কিন্তু যে মানুষগুলো কায়িক পরিশ্রম করে জীবন চালান, তাদের পক্ষে এই চিকুনগুনিয়া থেকে সুস্থ হয়েও স্বভাবিক কাজে ফিরে যাওয়া সম্ভব কিনা, সেটা ভাবতে হবে।’
মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডের একটি বিউটি পার্লার ও জিম চালিয়ে দুই মেয়ে আর মাকে নিয়ে সংসার চালান সুলতানা সাকো। তিনি বলেন, ‘গত দুই মাস ধরে আমি চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত। একমাসের বেশি হলো জ্বর ছেড়ে গেছে। এখনও হাতে-পায়ে পানি এসে ফুলে গেছে। একটু দাঁড়িয়ে কাজ করলেই পা ফুলে যাচ্ছে, বৃদ্ধদের মতো হাত-পা কাঁপে, বেসিনের কল খুলতে কষ্ট হয়, বোতলের ঢাকনা খুলি অনেক কষ্টে। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর হাত এমনভাবে ফুলে থাকে যে, হাত মুঠো করতে পারি না। ঘাড় ঘোরাতে হয় অনেক কষ্টে।’
শারীরিক সমস্যার পাশাপাশি আর্থিক ক্ষতির কথা জানিয়ে সুলতানা বলেন, ‘আমার উপার্জনেই সংসার চলে। ঈদের আগে পার্লারে বেশি মানুষ হয়, ইনকাম হয় বেশি। এই চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে বিছানায় পড়ে ছিলাম। কোনও ক্লায়েন্টে আসেননি। আমার জিম এখনও ফাঁকা। এভাবে চলতে থাকলে সংসার চালাতে কষ্ট হবে। শুধু তাই নয়, যারা জিমে আসতেন, তাদেরও একই অবস্থা।’
সেবিকা ও সুলতানার কথার সত্যতা পাওয়া গেলো মালিবাগ বস্তিতে গিয়ে। সেখানে ঘরে ঘরে চিকুনগুনিয়ার রোগী। রিকশা চালিয়ে, বাসায় কাজ করে যেসব মানুষ উপার্জন করেন, তারা বিছানায় পড়ে আছেন। এভাবে তারা কতদিন বিছানায় থাকতে পারবেন, সে বিষয়ে তারা শঙ্কিত। এভাবে চলতে থাকলে না খেয়ে মরতে হবে মন্তব্য করলেন রিকশা শ্রমিক নূর মোহাম্মদ।
চিকুনগুনিয়াতে আক্রান্তরা দীর্ঘমেয়াদি গিঁটের ব্যথায় ভুগতে পারেন বলে মন্তব্য করেছেন ইব্রাহীম কার্ডিয়াক হাসপাতালের ভাসকুলার সার্জন ডা. সাকলায়েন রাসেল। তিনি বলেন, ‘অন্য রোগে যারা আগে থেকেই আক্রান্ত ছিলেন, তাদের সমস্যা বেশ জটিল হবে। আবার আক্রান্তদের মধ্যে প্রায় ১০ শতাংশের মানুষ দীর্ঘমেয়াদি বাতের ব্যথায় ভুগছেন।’
ডা. সাকলায়েন রাসেল বলেন, ‘এখন জ্বর তিন থেকে চার দিনের মধ্যে সেরে গেলেও বাতের ব্যথায় আক্রান্ত রোগীদের হাসপাতালে আসার সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। হাতের কবজি, হাঁটু, পায়ের পাতা ও পায়ের গোড়ালির ব্যথায় ভুগছেন। কারও কারও ক্ষেত্রে এই ব্যথা তীব্র আকার ধারণ করেছে।’
জুলাই মাসেই স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (আইইডিসিআর) চিকুনগুনিয়ার জন্য নিয়ন্ত্রণকক্ষ প্রতিষ্ঠা করা হয়। আইইডিসিআর-এর পরিচালক অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা বলেন, ‘গত তিন মাসে আইইডিসিআর ৬৪৩জন ব্যক্তির রক্ত ও লালার নমুনা পরীক্ষা করেছে, যেখানে ৫১৩ জনের চিকুনগুনিয়া পজিটিভ এসেছে।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, ‘চিকুনগুনিয়ার এই ব্যথা এত তীব্র যে, মানুষ তার স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা হারাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে বিপুল-সংখ্যক বেসরকারি চাকরিজীবী কর্মহীন হবেন।’ তিনি বলেন, ‘এখন জ্বরের চেয়ে বেশি রোগী আসছে ব্যথা নিয়ে। অধিকাংশই স্বাভাবিক কাজে ফিরতে পারছেন না। নিম্নবিত্তের লোকদের জন্য এটা ভীষণভাবে অ্যালার্মিং।’
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অঞ্চলের সাবেক পরামর্শক ডা. মোজাহেরুল হক বলেন, ‘জুলাই মাসের শুরুর দিক থেকে সরকার নানা উদ্যোগ নিচ্ছে। অথচ চিকুনগুনিয়া নিয়ে আতঙ্ক ছিল ফেব্রুয়ারি থেকেই। কেবল মেডিক্যাল শিক্ষার্থীদের দিয়ে একদিন রাস্তায় সচেতনতা কর্মসূচি দিয়ে যদি চিকুনগুনিয়া ঠেকানো সম্ভব হতো, তাহলে আর চিকিৎসার প্রয়োজন হতো না। শুরু থেকেই যদি এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো সঠিক পদক্ষেপ নিতো, তাহলে আজ এ অবস্থা হতো না।’ মানুষের এই তীব্র কষ্টের দায় যাদের নেওয়ার কথা, তারা নিচ্ছেন না বলেও তিনি অভিযোগ করেন। সূত্র : বাংলা ট্রিবিউন
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)
একই রকম সংবাদ সমূহ
‘ভোমরা স্থলবন্দরকে পূর্ণাঙ্গ বন্দর করা হবে’ : নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী
সাতক্ষীরা ভোমরা স্থলবন্দর উন্নয়ন ও পরিচালনা গতিশীলতা আনয়নের নিমিত্ত গঠিতবিস্তারিত পড়ুন
টিকাদানের সাফল্যে ‘ভ্যাকসিন হিরো’ পেলেন প্রধানমন্ত্রী
টিকাদানের সাফল্যে ‘ভ্যাকসিন হিরো’ পেলেন প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশে টিকাদান কর্মসূচি একটিবিস্তারিত পড়ুন
সর্বজনীন স্বাস্থ্য কর্মসূচির অগ্রগতি ত্বরান্বিত করার আহ্বান
জাতিসংঘের ৭৪তম সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে নিউ ইয়র্কে এসেবিস্তারিত পড়ুন