সমাগত মাহে রমজান, প্রস্তুতি নিন রহমত, মাগফেরাত ও নাজাতের
ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের অন্যতম স্তম্ভ হচ্ছে সাওম বা রোযা। একজন ব্যক্তির আধ্যাত্মিক ও সামাজিক উন্নতি সাধনে রোজার গুরুত্ব অপরিসীম।
রোজা আমাদের আত্মশুদ্ধি ও নৈতিকতার শিক্ষা দেয়। বছর ঘুরে সমাগত মাহে রমজান। রমজান আসার আগেই আমাদের মানসিক ও শারীরিক প্রস্তুতি প্রয়োজন। রমজান মাসে বান্দার জন্য রহমত, মাগফেরাত ও নাজাতের ঘোষণা করা হয়েছে। অতএব, রোজা পালনের মাঝ দিয়ে এ মাসে আমাদের ইবাদত বন্দেগিতে আল্লাহর দরবারে সপে দিতে হবে।
রোজা বা সাওমের পরিচয় সাধারণ লোকেরা মনে করে যে, সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত না খেয়ে থাকা আর তারাবিহর নামাজ পড়াই বুঝি রোজা। অথচ আমাদের পুরো শরীরের আলাদা আলাদা রোজা রয়েছে। রোজার প্রকৃত সংজ্ঞা জানা না থাকার কারণে আমরা এর গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারি না।
সাওম আরবি শব্দ, ফার্সীতে রোজা, বাংলায় উপবাস থাকা, বিরত থাকা, সাধনা করা ইত্যাদি। যদিও রোজা ফার্সী শব্দ তবুও এটিই আমাদের দেশের প্রচলিত ভাষা। পরিভাষায় রোজা হলো-
(১) জমহুর ওলামায়ে কেরামের মতে, নির্দিষ্ট শর্তাবলির মাধ্যমে নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট কাজ থেকে বিরত থাকার নাম সাওম বা রোজা।
(২) শরহে বেকাহ প্রণেতা বলেন, রোজা হলো সুবহে সাদিক হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও যৌনসম্ভোগ হতে বিরত থাকা।
(৩) আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী (রহ.) বলেন, ভোজন, পান করা ও স্ত্রী সহবাস থেকে বিরত থাকার নাম আস সাওম বা রোজা।
(৪) আমার মতে, নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট পন্থায় সুবহে সাদিক হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সকল প্রকার পাপাচার, পানাহার ও কামাচার থেকে আত্মসংযম করে থাকাই সাওম বা রোজা।
(৫) রোজার আধ্যাত্মিক গুরুত্ব: স্রষ্টা ও সৃষ্টির মাঝে নিবির সম্পর্ক স্থাপনে রোজার আধ্যাত্মিক গুরুত্ব অপরিসীম। নিম্নে এ ব্যাপারে আলোকপাত করা হলো-
(১) তাকওয়াবান বানানো: রোজা প্রথমেই আমাদের তাকওয়া বা আল্লাহভীতি অর্জনের শিক্ষা দেয়। বান্দা যখন আল্লাহর ভয়ে ভীত হয়, তখন সে রোজা রাখতে সক্ষম হয়। আর এভাবেই বান্দা তাকওয়াবান হয়। যেমন: মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, হে ঈমানদারগন! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমনিভাবে তোমাদের পূর্ববর্তীগণের ওপর ফরজ করা হয়েছিল, যাতে তোমরা অবশ্যই আল্লাহ ভীরু হতে পার। (সূরা বাকারা-১৮৩)।
(২) আল্লাহর নৈকট্য লাভের সুযোগ: রোজার মাধ্যমে মানুষ নিজেকে আল্লাহ তায়ালার প্রিয় বান্দা হিসাবে তাঁর নৈকট্য লাভের সুযোগ পায়। যেমন, আল্লাহ তায়ালা বলেন, রোজা আমার জন্য আর এর প্রতিদান আমিই দেব। (হাদিসে কুদসি ও মুত্তাফাকুন আলাইহি)।
(৩) রোজা ঢালস্বরূ: রোজাদার বান্দা শয়তানের প্রবন্চনা ও কুপ্রবত্তির প্ররোচনা থেকে একমাত্র রোজার মাধ্যমেই বাঁচতে পারে। যেমন, রাসূল (সা.) বলেন, রোজা বান্দার জন্য ঢালস্বরূপ। (মুত্তাফাকুন আলাইহি)।
(৪) রোজা গুনাহ মার্জনাকারী: রোজা রাখলে বান্দার অতীত জীবনের যাবতীয় গুনাহখাতা মাফ করা হয়। যেমন, নবী করীম (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি বিশ্বাসের সঙ্গে ও সওয়াবের আশায় রমজানের রোজা রাখবে মহান আল্লাহ তায়ালা তার পূর্ববর্তী (ছগীরা) গুনাহ সমূহ ক্ষমা করে দিবেন। (মুত্তাফাকুন আলাইহি)।
(৫) রোজা সুপারিশকারী: কেয়ামতের দিন রোজা বান্দার জন্য মহান আল্লাহ তায়ালার নিকট সুপারিশ করবে। যেমন, রাসূলে কারীম (সা.) বলেন, রোজা বলবে হে আমার রব! আমি তাকে দিনের বেলায় খাবার ও কামাচার থেকে বিরত রেখেছি, অতএব তার স্বপক্ষে আমার সুপারিশ কবুল করুন। (বায়হাকী)।
(৬) আধ্যাত্মিক শক্তির সোপান: রোজার আত্মিক শিক্ষা প্রকৃত রোজা পালনকারীর সমগ্র জীবনে প্রভাব বিস্তার করে। যেমন: আল্লাহ তায়ালা বলেন, তোমরা পাথেয় বা সম্বল অবলম্বন করো, কেননা সর্বোত্তম পাথেয় হলো আল্লাহভীতি। (সূরা বাকারা-১৯৭)।
(৭) ইবাদতে আগ্রহ বৃদ্ধি: রোজা মানুষের চিন্তা চেতনা এবং মহান আল্লাহর সার্বভৌমত্বের স্বীকারোক্তি ও অঙ্গিকার সুদৃঢ় করে। ফলে ইবাদতের প্রতি তার আগ্রহ বৃদ্ধি পায়।
(৮) আরশের ছায়ায় স্থানলাভ: আরশের ছায়া পাবার উপযুক্ত ব্যক্তিগণের মাঝে রোযাদার ব্যক্তি অন্যতম।
(৯) নিয়মানুবর্তিতার প্রশিক্ষণ: রমজান মাসে সাওম নির্দিষ্ট সময়ে কিছু নির্দিষ্ট কাজের মাধ্যমে আমাদের নিয়মানুবর্তিতার শিক্ষা দেয়।
(১০) সহনশীল করে তোলে: রোজা আমাদের ধৈর্য্য ও সহনশীলতার শিক্ষা দেয়। সামনে সুস্বাদু খাবার ও স্ত্রী থাকা সত্তেও রোজা থাকায় ধৈর্যশীলতার পরিচয় দিয়ে বান্দা তা থেকে বিরত থাকে। ফলে সে আল্লাহর কাছে ধৈর্যশীল বান্দা হিসাবে জান্নাত করতে পারে। যেমন, রাসূল (সা.) বলেন, রমজান মাস হলো ধৈর্যের মাস আর ধৈর্যের প্রতিদান হলো জান্নাত। (বায়হাকী)।
রোজার সামাজিক গুরুত্ব: সাওম শুধু ব্যক্তিকেন্দ্রিক ইবাদত নয়, এর কিছু সামাজিক গুরুত্বও রয়েছে। যথা-
(১) সহানূভূতি ও সহমর্মিতা : রোজা রাখার মাধ্যমে একজন বিত্তশালী ক্ষুধার যন্ত্রণা বুঝতে পারে। ফলে তার মাঝে অনাহারে অর্ধাহারে থাকা মানুষের ওপর সহানুভূতি ও সহমর্মিতাভাব জাগ্রত হয়। যেমন, রাসূল (সা.) বলেন, রমজান মাস হলো পারস্পরিক সহর্মিতার মাস। (বায়হাকী)।
(২) সাম্য প্রতিষ্ঠা: ইসলাম যে সাম্যবাদী তা প্রমাণ হয় রমজান মাসে তারাবীহর নামাজ ও ইফতারের সময় যেখানে কোনো ধনী-গরীবের পার্থক্য থাকে না।
(৩) আর্থিক উন্নতি: রমজান মাসে নেক আমলের সওয়াব দ্বিগুণ হওয়ায় বিত্তশালীগণ বেশি বেশি জাকাত, ফিতরা, দান-সদকা আদায় করে ফলে গরীবদের অন্তত এ মাসের জন্য হলেও আর্থিক উন্নতি সাধন হয়। এতে দাতারও রিজিক বৃদ্ধি পায়। যেমন- রাসূল (সা.) বলেন, এটা ওই মাস যাতে মুমিন ব্যক্তির রিযিক বৃদ্ধি পায়। (বায়হাকী)।
(৪) সদাচারী হতে উৎসাহ প্রদান: রোজা সমাজের অবহেলিত দিনমজুরের প্রতি উদারতা ও সদ্ব্যবহারের উৎসাহ প্রদান করে। যেমন- নবী করীম (সা.) রমজান মাসে শ্রমিকের কাজ হালকা করার নির্দেশ দিয়ে বলেন, যে ব্যক্তি তার মজুরের কাজ কমিয়ে দিবে মহান আল্লাহ তায়ালা তাকে ক্ষমা দিবেন। (বায়হাকি)।
(৫) ঝগড়াবিবাদ থেকে মুক্তি: রোজাদার যাবতীয় ঝগড়া-ফাসাদ থেকে নিজেকে সংযত রাখে। রোজার কল্যাণজনিত এ সংযমের ফলে সমাজে অনেক দ্বন্ধ-কলহ কমে যায়। যেমন: রাসূল (সা.) বলেন, রোজাদারের সঙ্গে যদি কেউ কটু কথা বলে অথবা ঝগড়া করতে আসে তবে সে যেন বলে আমি রোজাদার। (মুত্তাফাকুন আলাইহি)।
(৬) নৈতিক বিকাশ সাধন: রোজার মাধ্যমে মানুষের নৈতিকতার উন্নতি হয়। রোজাদার ব্যক্তি সর্বাবস্থায় আল্লাহর স্মরণে থাকে, ফলে সে সকল প্রকার অশ্লীল ও অন্যায় কাজ হতে বিরত থাকে। যেমন রাসূল (সা.) বলেন, তোমাদের কারো সামনে রোজার দিন আসে তবে সে যেন অশ্লীল কথাবার্তা না বলে এবং শোরগোল না করে। (মুত্তাফাকুন আলাইহি)।
আদর্শ সমাজ গঠন: সিয়াম সাধনার মাধ্যমে মানুষ ষড়রিপুর তাড়না থেকে নিজেকে সংযত রাখে। যার ফলে রোজাদার ব্যক্তি একটি সুন্দর ও আদর্শ জীবন লাভ করে। এ জীবনের প্রভাব যে সমাজে পড়ে সে সমাজ একটি সুন্দর ও আদর্শ সমাজ হিসাবে গড়ে ওঠে।
ইসলাম আমাদের জন্য যে সাওম বা রোজা প্রবর্তন করেছে তা শুধু ব্যক্তি জীবনের পারলৌকিক কল্যাণ কামনাই নয়, বরং সামাজিক জীবনেও এর গুরুত্ব রয়েছে। তাই রোজার গুরুত্ব ও ফজিলত উপলব্ধি করে আমাদের উচিত এর প্রতি যত্নবান হওয়া।
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)
একই রকম সংবাদ সমূহ
‘ভোমরা স্থলবন্দরকে পূর্ণাঙ্গ বন্দর করা হবে’ : নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী
সাতক্ষীরা ভোমরা স্থলবন্দর উন্নয়ন ও পরিচালনা গতিশীলতা আনয়নের নিমিত্ত গঠিতবিস্তারিত পড়ুন
টিকাদানের সাফল্যে ‘ভ্যাকসিন হিরো’ পেলেন প্রধানমন্ত্রী
টিকাদানের সাফল্যে ‘ভ্যাকসিন হিরো’ পেলেন প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশে টিকাদান কর্মসূচি একটিবিস্তারিত পড়ুন
সর্বজনীন স্বাস্থ্য কর্মসূচির অগ্রগতি ত্বরান্বিত করার আহ্বান
জাতিসংঘের ৭৪তম সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে নিউ ইয়র্কে এসেবিস্তারিত পড়ুন