ওয়ান-ইলেভেন নিয়ে অবস্থান পরিষ্কার ড. ইউনূসের
ওয়ান-ইলেভেনের ভূমিকা নিয়ে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করলেন শান্তিতে নোবেলজয়ী প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস। প্রথম আলোর ঈদসংখ্যায় প্রকাশিত মহিউদ্দিন আহমদ রচিত ‘১/১১’ প্রবন্ধে জেনারেল মইন ও ব্রিগেডিয়ার বারীর সাক্ষাৎকার নিয়ে বিভিন্ন পত্রিকায় নিজ অবস্থান ব্যাখ্যা করে বক্তব্য পাঠান তিনি।
ব্যাখ্যায় প্রফেসর ইউনূস বলেন, …‘জেনারেল মইন ও ব্রিগেডিয়ার বারীর দুটি সাক্ষাৎকারে তাঁরা উভয়েই সেনাবাহিনী সমর্থিত নতুন কেয়ারটেকার সরকারের প্রধান হতে সেনাবাহিনীর প্রস্তাবে আমি কেন রাজি হইনি এ বিষয়ে অভিন্ন কথা বলেছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁরা উভয়েই তাঁদের সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে, কেয়ারটেকার সরকার দুই বছরের মেয়াদে সীমাবদ্ধ থাকায় আমি তার দায়িত্ব গ্রহণে অনীহা প্রকাশ করি। যেহেতু দুই বছরের কাঠামোর মধ্যে এই শীর্ষ পদটি নিতে আমি অস্বীকৃতি জানিয়েছিলাম, তাই তাঁদেরকে অন্য কাউকে বেছে নিতে হয়েছিল। সেনাবাহিনীর প্রস্তাবে আমি কেন রাজি হইনি এ বিষয়ে তাঁরা যে কারণের উল্লেখ করছেন তা একেবারেই কল্পনাপ্রসূত। একেবারে হদ্দ বোকা না হলে একজন অরাজনৈতিক বেসামরিক ব্যক্তি সেনাবাহিনীর নিকট তাঁকে দীর্ঘমেয়াদের জন্য একটি সরকারের প্রধানের পদে রাখার এরকম আবদার করার কথা কখনো চিন্তা করতে পারবে না।
ড. ফখরুদ্দীন আহমদের কেয়ারটেকার সরকার গঠনের পূর্বে আমার সঙ্গে কী আলাপ হয়েছিল তা নিচে তুলে ধরলাম।
শুরু করছি জানুয়ারি ১০, ২০০৭ দিয়ে। ওই দিন বিকেল ৫.৩০টা নাগাদ আমি সেনাপ্রধানের নিকট থেকে একটি টেলিফোন পাই। আমি সে সময়ে আমার অফিসে গ্রামীণ ব্যাংকের দুজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ করছিলাম। সেনাপ্রধানের সঙ্গে আমার কোনো পূর্বপরিচয় ছিল না। তিনি তাঁর পরিচয় দিয়ে সরাসরি কাজের কথায় চলে এলেন। তিনি বললেন, দেশকে এই বিশৃঙ্খল অবস্থা থেকে রক্ষা করতে দেশ পরিচালনার জন্য সেনাবাহিনী একটি নতুন কেয়ারটেকার সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং তাঁরা আমাকে এই সরকারের প্রধান করতে চান। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিকতাগুলো সম্পন্ন করার জন্য তিনি আমাকে প্রস্তুত থাকতে বলেন। আমি তাঁর সদয় প্রস্তাবের জন্য তাঁকে ধন্যবাদ জানাই, তবে একই সঙ্গে এ কথাও বলি যে, তাঁরা এ জন্য অন্য কাউকে খুঁজে নিলে ভালো করবেন, কেননা আমি এ প্রস্তাবে সম্মত নই। বোধহয় তিনি এমন একটি জবাবের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না, বরং এমনটি আশা করছিলেন যে, আমি অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে তাঁর প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাব। তিনি তাঁর প্রস্তাবটা আবারও ঘুরিয়ে করলেন; সম্ভবত এমনটা ভেবে যে, আমি বোধহয় তাঁর প্রস্তাবটি বুঝতে পারিনি। আমি আবারও প্রস্তাবটা নাকচ করে দিলাম এবং বললাম যে, তাঁরা তাঁদের দ্বিতীয় পছন্দের ব্যক্তিকে নিয়ে অগ্রসর হতে পারেন। তিনি বললেন যে, তাঁদের কোনো দ্বিতীয় পছন্দের ব্যক্তি নেই এবং তাঁদের পুরো পরিকল্পনাটিই আমাকে সরকারপ্রধান হিসেবে নিয়ে তৈরি করা। আমি তাঁকে নিরাশ করার জন্য দুঃখ প্রকাশ করলাম, তবে এটা সুস্পষ্ট করলাম যে, কেয়ারটেকার সরকারের প্রধান হবার কোনো অভিপ্রায় আমার নেই। তিনি বোধহয় বুঝতে পারলেন যে, আমার মত পরিবর্তন করানোটা সহজ হবে না; তাই তিনি বললেন যে, তিনি পুরো বিষয়টা আমার কাছে পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য তাঁর সহকর্মীদের আমার কাছে পাঠাবেন। আমি বললাম যে, আমি তাঁদের সঙ্গে কথা বললে খুশি হব, কিন্তু আমার সিদ্ধান্তের কোনো পরিবর্তন হবে না।
আমাদের কথাবার্তা সেখানেই শেষ হলো। এটা বুঝে উঠতে আমার কয়েক মিনিট লেগে গেল যে, সেনাবাহিনী প্রধান সত্যি সত্যি আমাকে ফোন করে দেশের সরকারপ্রধান হতে প্রস্তাব দিচ্ছেন! ঘটনার আকস্মিকতা ও তাত্ক্ষণিক হতবিহ্বলতা কাটিয়ে আমি আমার সহকর্মীদের কাছে, যাঁরা পুরো আলোচনার সময়ে আমার সামনেই বসেছিলেন এবং আমার পুরো ফোনালাপ শুনছিলেন, বিষয়টা বললাম। সেনাপ্রধান আমাকে কী বলেছেন তা আমি পুরোটা তাঁদের কাছে বর্ণনা করলাম। তাঁরা হতভম্ব হয়ে গেলেন। তাঁরা বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না যে, আমি এমন একটা প্রস্তাব সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছি, যা কিনা অন্য যে-কেউ হলে তাত্ক্ষণিকভাবে লুফে নিত। আমি আমার সহকর্মীদের বললাম যে, আমি একেবারে সঠিক কাজটিই করেছি। কিন্তু তাঁরা আমার জবাবে খুবই বিস্মিত ও হতাশ হলেন।
কিছুক্ষণ পর আমি আরেকটি টেলিফোন পেলাম। আমি তখনো অফিসে। জেনারেল মাসুদ বললেন যে, তিনি আমার সঙ্গে দেখা করতে আমার বাসায় আসতে চান। যেহেতু সাক্ষাৎ করতে “না” করার কোনো উপায় ছিল না, আমি তাঁকে ৮টায় আসতে বললাম।
জেনারেল মাসুদ ব্রিগেডিয়ার আমিন ও পাঁচ-ছয়জন জওয়ানসহ গ্রামীণ ব্যাংক কমপ্লেক্সে আমার বাসভবনে এলেন। আমি তাঁদের স্বাগত জানালাম এবং একটি ছোট কক্ষে নিয়ে গেলাম। তাঁরা নিজেদের পরিচয় দিলেন এবং অত্যন্ত বিনীতভাবে তাঁদের আসার উদ্দেশ্য জানালেন। আমি আমার অপারগতার কথা যতবারই বলতে থাকলাম, তাঁরাও তত বেশি বিনয়ী ও নাছোড়বান্দা হতে থাকলেন। তাঁরা তাঁদের পুরো পরিকল্পনা আমার কাছে তুলে ধরলেন। মত পাল্টাতে পারি এমন কোনো ধারণার যাতে সৃষ্টি না হয় সেটা বজায় রেখে তাঁরা কীভাবে তাঁদের পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হতে চান তা বোঝার জন্য আমি বিভিন্ন প্রশ্ন করতে থাকলাম। আমি আশা করছিলাম, তাঁরা একবার বুঝে গেলে যে আমি আমার মত পরিবর্তন করব না, তাঁরা চলে যাবেন। কিন্তু তাঁদের মধ্যে যাবার কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছিল না। তাঁরা বললেন যে, তাঁদের আসার উদ্দেশ্যই হলো আমাকে পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝতে সাহায্য করা এবং তাঁদের প্রস্তাব গ্রহণ করে তাঁদেরকে সহায়তা করতে আমাকে রাজি করানো। তাঁরা সংশ্লিষ্ট সব বিষয় এবং এগুলোর সমাধানে তাঁদের পরিকল্পনাগুলো আমাকে জানান। আমি বারবার বলতে থাকি যে, আমি তাঁদের যুক্তিগুলো পরিষ্কার বুঝতে পারছি, কিন্তু তাঁদের আমাকে ছাড়াই অগ্রসর হতে হবে। তাঁরা অনেকবার বোঝানোর চেষ্টা করলেন সেনাবাহিনীর পূর্ণ সমর্থনপুষ্ট এই নতুন উদ্যোগের নেতৃত্ব দিতে আমার রাজি হতে বাধা কোথায়। তাঁরা বললেন যে, সরকারের বাইরে থেকে দরিদ্র মানুষদের জন্য আমি যা করতে চাইছি তা বাস্তবায়নে এটা বরং আমার জন্য একটা চমৎকার সুযোগ; আমি একবার রাজি হলে সরকারের বিশাল ক্ষমতা ব্যবহার করে এই লক্ষ্যে আমি সবকিছুই করতে পারব।
আমার পক্ষ থেকে আমি বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে, “আপনাদের প্রস্তাবে রাজি হওয়ার গুরুত্ব আপনারা ভালোভাবেই আমার কাছে তুলে ধরেছেন। কিন্তু আমি তো রাজি হতে পারছি না।” আমি আরও বলি যে, আমার জন্য তাঁদের অপেক্ষা করার প্রয়োজন নেই, কেননা দেশে অনেক যোগ্য ও নিবেদিতপ্রাণ লোক আছেন যাঁরা হয়তো তাঁদের সঙ্গে কাজ করতে পারলে খুশি হবেন। তাঁরা আমার কাছে এমন কয়েকজনের নাম জানতে চান। আমি আমার কিছু বন্ধু এবং পরিচিত কয়েকজনের নাম বলি। এর মধ্যে আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ড. ফখরুদ্দীনের নামও ছিল। তাঁরা প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে আমার মত পরিবর্তনের চেষ্টা করেন। শেষমেশ তাঁরা এই বলে উঠে পড়েন যে, “আমরা সকালে আবার আসব। প্লিজ, আমরা যা আলোচনা করলাম তা সবদিক থেকে ভালোভাবে ভেবে দেখুন এবং আপনার সহকর্মী ও বন্ধুদের সঙ্গেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করুন। আশা করি কাল সকালে আপনার কাছ থেকে আমরা একটা সুসংবাদ পাব।” আমি বললাম যে, আমি নিশ্চয়ই বিষয়টা গুরুত্বের সঙ্গে ভাবব, কিন্তু তাঁদের আর সময় নষ্ট করে আসার প্রয়োজন নেই। কেননা আমার জবাব একই হবে। তাঁরা বরং তাঁদের পরবর্তী পছন্দকে নিয়ে অগ্রসর হলেই ভালো করবেন।
তাঁরা আমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে খুব বিমর্ষ চিত্তে বিদায় নিলেন।
পরদিন ১১ জানুয়ারি আমি যথারীতি অফিসে যাই। আমি খুশি ছিলাম যে, তাঁরা সকালে আর আমাকে ফোন করেননি। সকাল প্রায় ১০টার দিকে আমার সহকর্মীরা আমাকে উত্তেজিতভাবে জানান যে, তাঁরা এইমাত্র শুনতে পেয়েছেন যে আমার বন্ধু ড. ফখরুদ্দীন আহমদ নতুন কেয়ারটেকার সরকারের প্রধান হিসেবে শপথ নিতে যাচ্ছেন। আমি স্বস্তি পেলাম।
জনাব মহিউদ্দিনের প্রবন্ধে বলা হয়েছে যে, আমি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলাম। তা মোটেই সঠিক নয়। এই অনুষ্ঠানে আমাকে আমন্ত্রণ করা হয়নি এবং আমি উপস্থিত ছিলাম না। আমাকে আমন্ত্রণ করা হবে এরকম কোনো ধারণাও আমার মনে আসেনি। আমি বরং খুশি হয়ে পড়েছিলাম এই ভেবে যে, আমার ওপর হঠাৎ যে প্রচণ্ড চাপ এসেছিল এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তার অবসান হয়ে গেল।’
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)
একই রকম সংবাদ সমূহ
‘ভোমরা স্থলবন্দরকে পূর্ণাঙ্গ বন্দর করা হবে’ : নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী
সাতক্ষীরা ভোমরা স্থলবন্দর উন্নয়ন ও পরিচালনা গতিশীলতা আনয়নের নিমিত্ত গঠিতবিস্তারিত পড়ুন
টিকাদানের সাফল্যে ‘ভ্যাকসিন হিরো’ পেলেন প্রধানমন্ত্রী
টিকাদানের সাফল্যে ‘ভ্যাকসিন হিরো’ পেলেন প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশে টিকাদান কর্মসূচি একটিবিস্তারিত পড়ুন
সর্বজনীন স্বাস্থ্য কর্মসূচির অগ্রগতি ত্বরান্বিত করার আহ্বান
জাতিসংঘের ৭৪তম সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে নিউ ইয়র্কে এসেবিস্তারিত পড়ুন