রাজগঞ্জে দেশের বৃহৎ ভাসমান সেতুর কারিগর
তিনি ইঞ্জিনিয়ার নন, তবে তিনি-ই ইঞ্জিনিয়ার
তিনি ইঞ্জিনিয়ার নন, তবে তিনি ইঞ্জিনিয়ার-ই। দেশের বৃহত্তম ভাসমান সেতুর কারিগর তিনি। ইঞ্জিনিয়ার নন এই অর্থে যে- তিনি পুথিগত কিংবা একাডেমিক স্বীকৃতিতে ইঞ্জিনিয়ার নন। তবে তিনি অবশ্যই ইঞ্জিনিয়ার। কারণ তিনি বাস্তবে এমন কারুকার্য আর নৈপূণ্য দেখিয়েছেন যে তিনি অবশ্যই ইঞ্জিনিয়ার।
হ্যা এমনই একজন রবিউল ইসলাম। যশোর জেলঅর মনিরামপুর উপজেলার ঝাপা বাওড়ে নির্মিত সুদীর্ঘ ভাসমান সেতু। এখন পর্যন্ত জানা গেছে- ওই সেতুটি-ই দেশের সর্ববৃহৎ বা দীর্ঘতম ভাসমান সেতু। শুধু দীর্ঘতম নয়, সেতুটির ডিজাইন নৈপূণ্যতেও রয়েছে নতুনত্ব ও ব্যতিক্রমী চিন্তাধারার বহি:প্রকাশ।
সরকারের অনুদান ও একাডেমিক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত যেকোন প্রকৌশলীর মতামত ছাড়াই সাতক্ষীরা ও যশোর জেলার মধ্যবর্তী মনিরামপুর থানাধীন ঝাঁপা বাওড়ে স্থানীয় ৫৬জন যুবক এবং গ্রামবাসীর উদ্দোগে নির্মিত হয়েছে ভাসমান সেতুটি। ওই সেতুর অন্যতম আকর্ষণ হলো- প্লাস্টিকের ব্যারেলে উপর লোহার পাটাতন দিয়ে সম্পূর্ণ পানির উপর ভাসমান অবস্থায় সেতুটির নির্মাণ।
৮ ফুট চওড়া ও ১ হাজার ফুট লম্বা ভাসমান সেতুটি তৈরিতে ৮০০টি প্লাস্টিকের ড্রাম, ৮০০ মণ লোহার অ্যাঙ্গেল ও ২৫০টি লোহার শিট ব্যবহার করা হয়েছে। আর ওই সেতুটির অন্যতম প্রধান কারিগর হলেন রবিউল ইসলাম।
‘একতাই বল’ প্রবাদের প্রমাণ রেখে রবিউল ইসলামের হাত ধরে মণিরামপুরের ঝাঁপা বাওড় বেষ্টিত ঝাঁপা গ্রামবাসী ‘দেশের প্রথম দীর্ঘতম ভাসমান সেতু’ নির্মাণের মধ্যে দিয়ে জয় করেছেন মানুষের মন।
জানা গেলো- ভাসমান সেতুটি তৈরির মূল কারিগর রবিউল ইসলাম অভাব-অনটনের কারণে মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোতে পারেননি। পুঁথিগত বিদ্যার জোর তেমন নেই। তাতে কী মেধার জোর তো আছে-ই। এই মেধা আর চেষ্টার জোরেই তিনি তৈরি করে ফেললেন দেশের দীর্ঘতম ভাসমান সেতু।
স্বশিক্ষিত এই প্রকৌশলীর রবিউল ইসলাম যে কাজটি করেছেন, তার খবর অনেকের জানা আবার অনেকের অজানা।
ঝাপা বাওড়টি অনেকে বড় নদী বলেও মনে করেন। কেননা ওই বাওড়ের প্রশস্ততা (আড়) কপোতাক্ষ-বেত্রবতীর চেয়েও অনেক বড়। আর লম্বায় যেকোন নদীর চেয়েও কম নয়। ওই বাওড়ের কারণে দু’পারের বাসিন্দাদের যাতায়াতে পোহাতে হয় চরম হয়রাণী ও ভাগান্তি। বাওড়ের এপার-ওপার করতে হতো নৌকা দিয়ে অথবা ১০/১৫ কিলোমিটার ঘুরে।
বলছিলাম গ্রামবাসীর উদ্যোগে যশোরের মনিরামপুর উপজেলার রাজগঞ্জের ঝাঁপা গ্রামে ভাসমান সেতুটির কথা। প্লাস্টিকের ড্রামের ওপর লোহার অ্যাঙ্গেল ও পাত বসিয়ে তৈরি সেতুটি লম্বায় এক হাজার ফুট। যে সেতু গোটা জনপদের দৃশ্যপট বদলে দিয়েছে। দুই পারের ৯ গ্রামের মানুষের পারাপারের দুর্ভোগ কমিয়েছে। ওই সেতুর কারিগর রবিউল ইসলাম। ভাসমান সেতুটির পাশে টাঙানো সাইনবোর্ডেও সেতু তৈরির কারিগর হিসেবে লেখা রয়েছে তাঁর নাম।
রবিউল ইসলামের বাড়ি যশোরের মনিরামপুর উপজেলার রাজগঞ্জ এলাকার অজপাড়ায়। তিনি যখন ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র, তখন আর্থিক সংকটের কারণে তাঁকে লেখাপড়ার পাট চুকাতে হয়। এরপর কাজ নেন লেদ মেশিনের দোকানে। সেখানেই দীর্ঘদিন কাজ শেখেন। শেখার পর বাবার দেয়া ৫০ হাজার টাকায় একটি লেদ মেশিন কিনে নিজেই দোকান করেন। ইঞ্জিনচালিত তিন চাকার যান, ট্রলিসহ বিভিন্ন যানের ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ তৈরির কাজ করতেন তিনি।
রবিউলের দোকানটি এখন রাজগঞ্জ বাজারে। প্রতিষ্ঠানের নাম বিশ্বাস ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ। হালকা প্রকৌশল শিল্পের ওই প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে ১০জন শ্রমিক কাজ করেন। এই ১০ জনকে নিয়ে তিনি তৈরি করেছেন ভাসমান সেতুটি। সময় লেগেছে পাঁচ মাস।
রবিউল ইসলাম জানান- ‘সেতুটি তৈরির জন্য প্রথম এক মাস পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে হয়েছে। এরপর আমার প্রতিষ্ঠানের ১০জন শ্রমিক নিয়ে চার মাস ধরে সেতু নির্মাণের কাজ করি। অর্থের জন্য নয়, সুনামের জন্যই কাজটি করেছি। এখানে লাভ-লোকসানের হিসাব নেই।’
সেতুটি নির্মাণের জন্য ৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা পেয়েছেন তিনি। তবে রবিউল ইসলাম যে শ্রম দিয়েছেন, তার মূল্য আরও অনেক বেশি বলে তিনি মনে করেন। শুধু গ্রামের মানুষের যাতায়াতের সুবিধার কথা ভেবেই কাজটি করেছেন- যোগ করেন তিনি।
বাস্তবতার ইঞ্জিনিয়ার রবিউল ইসলাম আরো জানান- ‘সেতুর মূল কাজ শুরুর আগে লোহার অ্যাঙ্গেল দিয়ে প্লাস্টিকের ড্রামের ওপর ২০ ফুটের মতো সেতু বানানো হয়। সেটার ওপর প্রায় ৩২ জন মানুষ উঠে দেখেছেন সেটি ডোবে কি না। পরীক্ষা সফল হলো। এরপরই শুরু হয় মূল কাজ।’
রবিউল ইসলাম সেতু নির্মাণের কাজ করলেও ভাসমান সেতুর মূল বিষয়টি প্রথম মাথায় আসে ঝাঁপা গ্রামের মো. আসাদুজ্জামানের।
আসাদুজ্জামানেরও প্রকৌশলগত কোনো শিক্ষা নেই। ঝাঁপার ওই বাঁওড়ের পানিতে প্লাস্টিকের ড্রামের ওপর দুটি ভারী শ্যালো মেশিন বসিয়ে কয়েকজন বালু উত্তোলন করছিলেন। সেটা দেখেই ভাসমান সেতুর চিন্তা আসে তাঁর মাথায়।
আসাদুজ্জামান জানান- ‘আমাদের কারোরই কারিগরি জ্ঞান নেই। “গাইতে গাইতে গায়েন”-এর মতো নিজেদের মাথা খাটিয়ে কাজটি করেছি। তবে মূল কাজটি করেছে রবিউল।’
নতুন বছরের প্রথম দিনেই ভাসমান সেতুটি উদ্বোধন করা হয়েছে। ৮ ফুট চওড়া ও ১ হাজার ফুট লম্বা সেতুটি তৈরিতে ৮০০টি প্লাস্টিকের ড্রাম, ৮০০ মণ লোহার অ্যাঙ্গেল ও ২৫০টি লোহার শিট ব্যবহার করা হয়েছে।
সেতুর দুই প্রান্তে শুষ্ক মৌসুমে শুকিয়ে যাওয়া ৩০০ ফুট অংশ কাটা বাঁশ দিয়ে সংযোগ সেতু তৈরি করা হয়েছে।
রবিউলের তৈরি সেতুর ওপর দিয়ে এখন ইজিবাইক, মহেন্দ্র, ভ্যান, মোটরসাইকেল, বাইসাইকেলসহ অন্যান্য ছোট-খাটো যান ও মানুষ অনায়াসে পারাপার হচ্ছেন।
কলারোয়া নিউজ এর পক্ষ থেকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা রবিউল ইসলাম ও তাঁর ১০কর্মচারী, প্রথম পরিকল্পনাকারী আসাদুজ্জামানসহ ঝাপা বাঁওড়বেষ্ঠিত ৫৬জন যুবক এবং গ্রামবাসীকে।
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)
একই রকম সংবাদ সমূহ
‘ভোমরা স্থলবন্দরকে পূর্ণাঙ্গ বন্দর করা হবে’ : নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী
সাতক্ষীরা ভোমরা স্থলবন্দর উন্নয়ন ও পরিচালনা গতিশীলতা আনয়নের নিমিত্ত গঠিতবিস্তারিত পড়ুন
টিকাদানের সাফল্যে ‘ভ্যাকসিন হিরো’ পেলেন প্রধানমন্ত্রী
টিকাদানের সাফল্যে ‘ভ্যাকসিন হিরো’ পেলেন প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশে টিকাদান কর্মসূচি একটিবিস্তারিত পড়ুন
সর্বজনীন স্বাস্থ্য কর্মসূচির অগ্রগতি ত্বরান্বিত করার আহ্বান
জাতিসংঘের ৭৪তম সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে নিউ ইয়র্কে এসেবিস্তারিত পড়ুন