স্মার্টকার্ড প্রকল্পে থাকছে বিশ্বব্যাংক, বাড়ছে মেয়াদ
স্মার্ট জাতীয় পরিচয়পত্র (স্মার্ট কার্ড) ‘আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেম ফর এনহ্যান্সিং অ্যাকসেস টু সার্ভিসেস (আইডিইএ)’ প্রকল্পে থাকছে বিশ্বব্যাংক। চুক্তি থাকাবস্থায় মেয়াদ হালনাগাদ করে প্রকল্পে যুক্ত থাকার ইঙ্গিত রয়েছে দাতা সংস্থাটির। কার্ড উৎপাদনে গতি কয়েকগুন বাড়ায় বিশ্ব ব্যাংকের বাংলাদেশ শাখার সন্তোষ প্রকাশে এই সম্ভাবনা জেগেছে। প্রশিক্ষিত ফ্রান্সের ওবার্র্থু টেকনোলজির উৎপাদনের সক্ষমতার চেয়ে তিনগুন বেশি গতিতে উৎপাদন হচ্ছে; নিজস্ব অর্থায়ন ও উদ্যোগে। পাশাপাশি, স্মার্ট কার্ডে পরিণত হওয়ার আগে ব্লাক কার্ডটিও এখন থেকে দেশেই উৎপাদিত হবে; যার সব প্রস্তুতি শেষ হয়েছে। সম্পন্ন হয়েছে ‘ডেমো’ উপস্থাপন ও পর্যালোচনা। বাংলাদেশ মেশিন টুলস্ ফ্যাক্টরি (বিএমটিএফ) জড়িত হয়েছে এই প্রযুক্তির সঙ্গে; অচিরেই ওবার্থুর মতোই ব্লাক কার্ড সরবরাহে তাদের সক্ষমতা দেখা যাবে।
চুক্তি লঙ্ঘনের কারণে ওবার্থুর কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ে সমঝোতা ও চিঠি চালাচালি অব্যাহত আছে। পাশাপাশি স্মার্ট কার্ড মুদ্রুণে ওবার্থুর ব্যর্থতার দায়ে ব্যাংক গ্যারেন্টির ১২০ কোটি টাকা এবং কার্ডের ব্যয় সংকোচনে ৬০ কোটি টাকাসহ মোট প্রায় ২০০ কোটি টাকা সরকারের সাশ্রয় হচ্ছে। জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন অনুবিভাগ (এনআইডি) সূত্রমতে, ফ্রান্সের ওবার্থূ টেকনোলজির সঙ্গে আইডিয়া প্রকল্পের সব ধরণের সম্পর্কের ইতি ঘটে গত ৩০ জুন তারিখে। মূলত দুটি কারণে এনআইডি উইং এবং সংস্থাটির মধ্যে দুরত্ব তৈরি হয়। প্রথমটি তাগিদ সত্বেও ওবার্থুর কার্ড উৎপাদনে চুক্তির নূন্যতম চুক্তির শর্ত-পূরণে চরম ব্যর্থতা। দ্বিতীয়টি দেশের নাগরিকদের সংরক্ষিত তথ্য-ভান্ডারে অনুপ্রবেশের অগতান্ত্রিক চর্চার ধৃষ্ঠতা দেখানো। জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন বিভাগের মহাপরিচালক ও আইডিয়া প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম সংস্থাটির চুক্তি হালনাগাদ করার বিষয়ে ওই দুটি কারণ অন্যতম বলে স্বীকার করেন। তার মতে, দেশের ১০ কোটি ১৭ লাখ নাগরিকের তথ্য-সংবলিত তথ্য-ভান্ডারের সার্ভারটিতে প্রবেশাধিকারের একমাত্র অগ্রাধিকার অনুমোদিত ব্যক্তিদের। কারণ এটিতে অন্যের এক্সেস থাকাটা রাষ্ট্রীয় স্বার্থের পরিপন্থী। এমনকি চুক্তি নিয়মিত না করে নিজস্ব উদ্যোগে স্মাট কার্ড মুদ্রুণের একক কৃতিত্বও বলা যায় এনআইডির ডিজির ।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চুক্তি বাতিল হওয়া ফ্রান্সের ওবার্থ কোম্পানি ৯ কোটি কার্ডের মধ্যে সরবরাহ করেছে ৭ কোটি ৭৩ লাখ ব্লাঙ্ক কার্ড। যার মধ্যে ১ কোটি ২৪ লাখ স্মার্ট কার্ড পারসোনালাইজেশন করে; যার হার ২শতাংশ। এখন ব্লাঙ্ক কার্ডগুলো পারসোনালাইজেশন করে ভোটারদের হাতে তুলে দিচ্ছে কমিশন। এছাড়া ব্লাক কার্ড না থাকা ২ কোটি ৪৫ লাখ ভোটারকে বিএমটিএফের উৎপাদিত ‘ব্লাক কার্ড’ পারসোনালাইজেশন করে ধাপে ধাপে তাদের হাতে তুলে দেওয়া হবে; এর জন্য নূন্যতম এক-দেড় বছর সময় লাগতে পারে।
এদিকে, গত বছরের ২ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্মার্টকার্ড বিতরণ কার্যক্রম উদ্বোধন করেন। পরদিন ৩ অক্টোবর থেকে রাজধানী ঢাকা ও বিলুপ্ত ছিটমহলবাসীদের মাঝে কার্ড বিতরণ শুরু হয়। ১১ অক্টোবর পর্যন্ত ঢাকার বিতরণ কার্যক্রম চলে। রাজধানীর বাইরে গত ১৬ মার্চ চট্টগ্রাম ও গত ২ এপ্রিল রাজশাহী মহানগরীতে কার্ড বিতরণ শুরু হয়েছে। এরপর পর্যায়ক্রমে অন্য ৫টি বিভাগীয় শহরে বিতরণ চলছে। এখন একযোগে নারায়নগঞ্জ, গাজীপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, কুমিল্লা, দিনাজপুর, নীলফামারী বিতরণ শুরু হয়েছে। আর বগুড়া জেলার কার্ড প্রস্তুতিও শেষ পর্যায়ে।
পারর্স সেন্টারের তথ্যনুযায়ী ওবার্থুর তুলনায় তিনগুন বেশি উৎপাদন বেড়েছে। নিজস্ব এবং ওবার্থুর উৎপাদনের তুলনা পর্যালোচনায় দেখা যায়, ওবার্থুর প্রতিমাসে সর্বোচ্চ উৎপাদন ছিল ৭লাখ এবং ৪টির বেশি মেশিন চালু রাখতে পারেননি। গত ২৭ আগষ্ট থেকে নিজস্ব উদ্যোগে কার্ড মুদ্রুণ শুরু করে ১০টি মেশিন চালু রেখে এখন পর্যন্ত প্রতিমাসে ৪৫ লাখ উৎপাদনের রেকর্ড সৃষ্টি করেছে অর্থাৎ ওবার্থুর চেয়ে তিনগুন বেশি উৎপাদন বেড়েছে। এ হিসেবে বলা যায়, স্মার্ট কার্ড মুদ্রুণে গতি বেড়েছে। এটিকে আরো ত্বরান্বিত করতে স্মার্টকার্ড উৎপাদন-পার্সোনালাইজেশনের কাজে সহায়তার জন্য অর্ধ-শতাধিক কর্মকর্তা চেয়ে সম্প্রতি সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসারের (পিএসও) কাছে চিঠি পাঠানো হয়।
এনআইডির ডিজি ও আইডিয়া প্রকল্পের পরিচালক খবরের সত্যতা স্বীকার করে বলেন, ওবার্থু কোনদিন ১০টি মেশিন সচল রাখতে পারেননি, যা আমরা পেরেছি। পাশাপাশি তাদের মাসিক উৎপাদন ছিল সর্বোচ্চ ৭ লাখ এবং আমাদের ৪৫ লাখ।
সূত্রমতে, দেশীয় উদ্যোগে স্মার্ট কার্ড উৎপাদনে কার্যক্রম হাতে নেওয়ার পর গত ১১ অক্টোবর বিশ্ব ব্যাংকের বাংলাদেশী মিশনের ৪ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণভাøারে অবস্থিত পারসু (স্মার্ট কার্ড উৎপাদন) সেন্টারে পরিদর্শনে যান। পুরো টিমই বিস্ময় প্রকাশ করেন উৎপাদনের গতি দেখে। কেন্দ্র পরিদর্শন করে দেশীয় উৎদ্যোগে এমন সাফল্যে নির্বাচন কমিশনের ভূয়সী প্রশংসা করেন। পাশাপাশি আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত চুক্তি থাকলেও ওবার্থুর ব্যর্থতার কারণে প্রকল্প থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেয়ার ছক ঠিক করলেও দেশীয় উদ্যোগে উৎপাদনের গতি দেখে চুক্তি নিয়মিত করে প্রকল্পে থাকতে উপায় খুঁজছে দাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংক।
আইডিয়া প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক এ প্রসঙ্গে বলেন, বিশ্বব্যাংক নিজস্ব উদ্যোগে স্মার্ট কার্ড উৎপাদন দেখতে সম্প্রতি পারসু সেন্টার পরিদর্শন করে উৎপাদনের গতি দেখে অবাক হয়েছেন। প্রশংসার পাশাপাশি প্রকল্পে থাকতে তাদের বক্তব্যের মধ্যে ইঙ্গিত দিয়ে গেছেন। অর্থাৎ ‘আমরাই পারি’ এটাই মূলমন্ত্র, যোগ করেন মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম।
২০১১ মে মাসে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে প্রায় ২০ কোটি ডলারের চুক্তি সই করে সরকার। এ প্রকল্পেও মোট ব্যয় ধরা হয়েছিল ১ হাজার ৩৭৯ কোটি ১৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে বিশ্বব্যাংকের সহযোগী সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের (আইডিএ) ঋণ ১ হাজার ৩৬৫ কোটি টাকা। দশমিক ৭৫ শতাংশ সার্ভিস চার্জে পাওয়া এ ঋণ বাংলাদেশকে ৪০ বছরের মধ্যে শোধ করতে হবে। এর মধ্যে প্রথম ১০ বছর কোনো সুদ দিতে হবে না। বিশ্বব্যাংকের ঋণ সহায়তায় এ প্রকল্পের অধীনে ২০১১ সালের জুলাই থেকে ২০১৬ সালের জুনের মধ্যে ৯ কোটি ভোটারের হাতে স্মার্টকার্ড তুলে দেয়ার কথা ছিল। পরে প্রকল্পের মেয়াদ দেড় বছর বাড়িয়ে চলতি ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত নির্ধারিত রয়েছে। স্মার্টকার্ড প্রস্তুত ও বিতরণের লক্ষ্যে ফ্রান্সের ওবার্থুর টেকনোলজিস নামে এক কোম্পানির সঙ্গে ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে প্রায় ৮০০ কোটি টাকার চুক্তি করে ইসি। ওই চুক্তির অধীনে নয় কোটি কার্ড উৎপাদন ও বিতরণের কথা ছিল। কয়েক দফায় পিছিয়ে সেই কার্ড বিতরণ শুরু হয় ২০১৬ সালে। পরবর্তীতে এ বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত মেয়াদ বাড়িয়েও সক্ষমতা দেখাতে ব্যর্থ হয় ওবার্থু; যার চূড়ান্ত পরিনতি সম্পর্ক ছেদ। এখন নিজস্ব উদ্যোগে ও জিওবি’র অর্থায়নে স্মার্ট কার্ড পাবেন ৯ কোটি ভোটার। পরবর্তী দেড় কোটি ভোটারকে নতুন প্রকল্পের অধীনে উন্নত প্রযুক্তির কার্ড দেবে নির্বাচন কমিশন।
এদিকে, চুক্তির শর্তনুযায়ী স্মার্ট কার্ড সরবরাহ ও বিতরণে ব্যর্থতার জন্য প্রকল্প থেকে সরিয়ে দেয়া ওবার্থুর বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ অব্যাহত রেখেছে নির্বাচন কমিশন। রাষ্ট্রের সুনাম ক্ষুন্ন করায় তাদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ নিয়ে চলছে চিঠি চালাচালি। এর জন্য বিশেষজ্ঞ আইনজীবী নিয়োগ করা আছে। তবে, ওবার্থু কোম্পানি বিলুপ্ত হয়ে নতুন আরেকটি কোম্পানি একত্রিত হওয়ায় কিছু কালক্ষেপন হচ্ছে। তবে কমিশনের চিঠির জবাব অব্যাহত রেখেছে।
পাশাপাশি ওবার্থু চুক্তিনুযায়ী কার্জটি সম্পন্ন করলে ব্যাংক গ্যারেন্টির ১২০ কোটি টাকা মুনাফা করতো, প্রকল্প শেষ না করায় এই টাকার পুরোটায় পাচ্ছে নির্বাচন কমিশন। পাশাপাশি স্মার্ট কার্ড এর পাউসসহ অতিরিক্ত কিছু কাজ কাঁটছাঁট করায় আরো প্রায় ৬০ কোটি টাকার মতো সাশ্রয় হচ্ছে। এ হিসেবে ২০০ কোটি টাকা দেশীয় উদ্যোগেহ স্মার্ট কার্ড মুদ্রুণে সরকারের গচ্চা কম লাগছে।
জানতে চাইলে এনআইডির ডিজি সাইদুল ইসলাম বলেন, ফ্রান্সের ওবার্থু প্রকল্প শেষ করলে তাদের মোট লভ্যাংশের সঙ্গে ব্যাংক গ্যারেন্টির ১২০ কোটি যুক্ত হতো, প্রকল্প শেষ না করায় পুরো টাকাই সরকারের তহবিলে থেকে যাচ্ছে। পাশাপাশি স্মাট কার্ডের সঙ্গে একটি খাম, নির্দেশীকা ড়াও কার্ডের পাউস না রাখায় প্রায় আরো ৬০ কোটি টাকা অর্থাৎ দুইশ কোটি টাকা সাশ্রয় হচ্ছে; যা স্মার্ট কার্ড প্রকল্পের পেছনে ব্যয় হবে। এছাড়া ওবার্থুর রাষ্ট্রীয় স্বার্থ ক্ষুন্ন করায় তাদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা অব্যাবহত রাখা হয়েছে বলে জানান প্রকল্প পরিচালক।
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)
একই রকম সংবাদ সমূহ
‘ভোমরা স্থলবন্দরকে পূর্ণাঙ্গ বন্দর করা হবে’ : নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী
সাতক্ষীরা ভোমরা স্থলবন্দর উন্নয়ন ও পরিচালনা গতিশীলতা আনয়নের নিমিত্ত গঠিতবিস্তারিত পড়ুন
টিকাদানের সাফল্যে ‘ভ্যাকসিন হিরো’ পেলেন প্রধানমন্ত্রী
টিকাদানের সাফল্যে ‘ভ্যাকসিন হিরো’ পেলেন প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশে টিকাদান কর্মসূচি একটিবিস্তারিত পড়ুন
সর্বজনীন স্বাস্থ্য কর্মসূচির অগ্রগতি ত্বরান্বিত করার আহ্বান
জাতিসংঘের ৭৪তম সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে নিউ ইয়র্কে এসেবিস্তারিত পড়ুন