হেলিকপ্টার থেকে গুলি করা হয় রোহিঙ্গাদের!
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের সবার জীবনের গল্প যেন এক। কষ্ট, দুর্ভোগ, ক্ষুধা, আতঙ্ক আর স্বজন হারানোর বেদনা। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা জানান, হেলিকপ্টার থেকে তাঁদের ওপর গুলি বা বিশেষ কিছু ছোড়া হতো। এতে অনেকে গুলিবিদ্ধ হন; প্রাণও হারান অনেকেই।
রোহিঙ্গাদের বরাত দিয়ে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের মুখপাত্র ভিভিয়ান তান সম্প্রতি কাতারভিত্তিক টিভি চ্যানেল আল-জাজিরাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এসব কথা জানান। গত দুই সপ্তাহে বাংলাদেশে প্রায় ২ লাখ ৭০ হাজার রোহিঙ্গা ঢুকেছে বলে জানিয়েছে ইউএনএইচসিআর। রাখাইন থেকে বেঁচে আসা রোহিঙ্গারা বলছেন, নারী, শিশু, বৃদ্ধ—কাউকেই ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। এই রক্তপাত বন্ধ করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, আঞ্চলিক শক্তি ও সরকারের প্রতি সাহায্যের আবেদন জানিয়েছেন তাঁরা।
আল-জাজিরাকে দেওয়া ভিভিয়ান তানের সাক্ষাৎকারের উল্লেখযোগ্য অংশ তুলে ধরা হলো:
আল-জাজিরা: পালিয়ে বাংলাদেশে ঢোকা রোহিঙ্গাদের অভিজ্ঞতা জানান, যা আপনি জেনেছেন।
ভিভিয়ান তান: বেঁচে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা প্রায় সবাই বলছে, ‘আমাদের ঘর পুড়িয়ে দিয়েছে, আমাদের সবকিছু পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।’
রোহিঙ্গাদের অনেকেই জানান, হেলিকপ্টার তাঁদের গ্রামের আকাশে চক্কর দিতে থাকে। হেলিকপ্টার থেকে কিছু ছুড়ে মারা হয়। গুলিও ছোড়া হয়। অনেকে জানান, তাঁরা তাঁদের পরিবারের সদস্য হারিয়েছেন।
তাঁরা কীভাবে পালিয়ে এসেছেন—এমনটা জানতে চাইলে সবাই বলেন, তাঁরা কয়েক দিন ধরে হেঁটেছেন। তাঁদের অনেকে সর্বনিম্ন তিন দিন সর্বোচ্চ নয় দিন পর্যন্ত হেঁটেছেন। জঙ্গলে-পাহাড়ে লুকিয়ে জীবন বাঁচান তাঁরা। তবে এই কঠিন সময়ে পরস্পরকে সাহায্য করছেন সবাই। এমনকি পথে সন্তানের জন্ম হওয়ার মতো ঘটনাও ঘটছে।
কয়েক দিন আগে আমি শ্যামলাপুর সীমান্ত থেকে সাত কিলোমিটার দূরে একটি সাগরতীর এলাকায় গিয়েছিলাম। সেখানে একটি পরিবার পেয়েছিলাম, যারা একটি শিশুসহ জঙ্গলে লুকিয়ে ছিল। সম্প্রতি টেকনাফের নয়াপাড়া শিবিরে এক বাবার সঙ্গে দেখা হয়। ক্লিনিকে এসেছেন। খুবই চিন্তিত দেখাচ্ছিল তাঁকে। একটি ঝুড়িতে কম্বলে মোড়ানো দুটি শিশু দেখতে পেলাম। তিনি জানান, কিছুক্ষণ আগে জন্মেছে তাঁর যমজ এই শিশু দুটি।
আল-জাজিরা: রোহিঙ্গা শিবিরগুলোয় শিশুদের অবস্থা কেমন?
ভিভিয়ান তান: বিপুলসংখ্যক বিচ্ছিন্ন ও পরিবারবিহীন শিশু রয়েছে শিবিরগুলোয়। কেউ কেউ সংঘাতে পরিবার হারিয়েছে। কেউ কেউ পালিয়ে আসার সময় পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। আবার কোনো কোনো শিশু আত্মীয় বা প্রতিবেশীর সঙ্গে শিবিরে রয়েছে। স্বেচ্ছাসেবী ও এনজিওর সঙ্গে মিলে আমরা অনেক চেষ্টা করছি তাদের চিহ্নিত করতে। তাদের বিশেষ নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে।
শিবিরে পুষ্টিহীনতায় ভোগা শিশু আছে। দেখলে প্রচণ্ড কষ্ট হয় যে তারা কেবল এই সহিংসতার জন্যই নয়, আগে থেকেই উপযুক্ত খাবারের অভাবে পুষ্টিহীনতায় ভুগছে।
আল-জাজিরা: ২ লাখ ৭০ হাজার শরণার্থীকে ভরণপোষণের মতো তহবিল কি জাতিসংঘের আছে?
ভিভিয়ান তান: না, আমাদের নেই; অন্তত এই মুহূর্তে নেই। রোহিঙ্গাদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। গত কয়েক দিনে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা ও এনজিও পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে রোহিঙ্গাদের ঠাঁই নেওয়া অনেক এলাকা পরিদর্শন করেছে। এ সময় এমন কিছু এলাকা খুঁজে পাওয়া গেছে, যেখানে রোহিঙ্গা আছে বলে আমাদের জানাই ছিল না।
তাই বলতে হচ্ছে, আমাদের কাছে যথেষ্ট তহবিল নেই। তবে দ্রুত চাহিদার কথা ভেবে আমরা যা চাই, তার একটি পরিষ্কার পরিকল্পনা তৈরি করে তহবিলের গঠনের ব্যবস্থা করা হবে।
আল-জাজিরা: বাংলাদেশে স্থানীয় লোকজন রোহিঙ্গাদের কীভাবে গ্রহণ করছে—আপনার মূল্যায়ন কী?
ভিভিয়ান তান: স্থানীয় লোকজনের প্রতিক্রিয়া বেশ উৎসাহব্যাঞ্জক। শ্যামলাপুর ও টেকনাফের মতো এলাকাগুলো গ্রামবাসী তাদের স্থান দিচ্ছে। একটি গ্রামে গত কয়েক দিনে ১০ হাজার রোহিঙ্গা ঢুকেছে। তারা তাদের আশ্রয় দিচ্ছে, খাদ্য দিচ্ছে। এমনকি রোহিঙ্গা শিবির থেকে বেশ দূরে কক্সবাজারেও মানুষ একত্র হয়ে খাদ্য, অর্থ সংগ্রহ করে রোহিঙ্গাদের জন্য পাঠাচ্ছে।
বছরের পর বছর ধরে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে ঢুকছেন। তাঁদের এই আগমন স্থানীয় লোকজনের জন্য ক্লান্তিকর হয়ে পড়লেও আচরণ খুবই ইতিবাচক। কিন্তু এই বিপুল জনগোষ্ঠীকে ভরণপোষণ করার জন্য স্থানীয় লোকজনের সম্পদ সীমিত। এ সবার সমর্থন প্রয়োজন।
আল-জাজিরা: রোহিঙ্গাদের অধিকার সম্পর্কে আপনার সবচেয়ে বড় উদ্বেগ কী, তাঁদের সুরক্ষার জন্য কী করা যায়?
ভিভিয়ান তান: এই মুহূর্তে দুটি জিনিস প্রয়োজন। এক. তাৎক্ষণিক চাহিদাগুলো পূরণ করা, যেমন: জীবন বাঁচাতে সহায়তা করা; খাদ্য, পানীয়, মাথার ওপর একটু ছাদ, প্রয়োজনীয় প্রাথমিক চিকিৎসা।
দুই. আইনি সুরক্ষা। নিবন্ধনের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।
গত ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের কয়েকটি তল্লাশিচৌকিতে উগ্রবাদীদের হামলার সূত্র ধরে রাখাইনে দমন অভিযান শুরু করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও পুলিশ। এরপর থেকেই প্রাণভয়ে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের ঢল নামে। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা সীমান্তের ওপারে সেনাবাহিনীর হত্যা, ধর্ষণ, ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও পরিকল্পিত দমন অভিযানের বিবরণ দেয়।
সূত্র: আল-জাজিরা
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)
একই রকম সংবাদ সমূহ
‘ভোমরা স্থলবন্দরকে পূর্ণাঙ্গ বন্দর করা হবে’ : নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী
সাতক্ষীরা ভোমরা স্থলবন্দর উন্নয়ন ও পরিচালনা গতিশীলতা আনয়নের নিমিত্ত গঠিতবিস্তারিত পড়ুন
টিকাদানের সাফল্যে ‘ভ্যাকসিন হিরো’ পেলেন প্রধানমন্ত্রী
টিকাদানের সাফল্যে ‘ভ্যাকসিন হিরো’ পেলেন প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশে টিকাদান কর্মসূচি একটিবিস্তারিত পড়ুন
সর্বজনীন স্বাস্থ্য কর্মসূচির অগ্রগতি ত্বরান্বিত করার আহ্বান
জাতিসংঘের ৭৪তম সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে নিউ ইয়র্কে এসেবিস্তারিত পড়ুন