হেফাজতের ১০৯ দিনের আন্দোলনে গ্রিক দেবীর ভাস্কর্য সরেছে ২০০ হাত
সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে ঝরণার কাছে মঙ্গলবার (৩০ মে) দুপুরে কাজ করছিলেন লিটন, মাহবুব ইসলাম ও সুলায়মান নামের তিনজন নির্মাণ শ্রমিক। আদালত প্রাঙ্গণের মূল চত্বর থেকে দেবী থেমিসের ভাস্কর্যটি কত দূরে সরানো হয়েছে—এমন প্রশ্ন করা হলে লিটন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আগের জায়গা থেকে এখন যেখানে বসাইছে এটার দূরত্ব ৩০০ ফুট অইবো। এর বেশি অইবো না।’ নিজের ধারণার ওপর যুক্তি দেখিয়ে তিনি বললেন, ‘পায়ে হাইট্টা (হেঁটে) গেলে ৩ মিনিট লাগবো। এর বেশি লাগবো না নিশ্চিত থাকেন।’ পাশে থাকা সুলায়মান ও মাহবুবও লিটনকে সায় দিলেন।বাংলা ট্রিবিউনের প্রতিবেদন।
সুপ্রিম কোর্টের প্রধান গেটের সামন থেকে গ্রিক দেবী থেমিসের ভাস্কর্যটি এখন প্রতিস্থাপন করা হয়েছে অ্যানেক্স ভবনের সামনের সবুজ ঘাসের গালিচা শোভিত আঙ্গিনায়। ভাস্কর্যটি প্রথম যেখানে বসানো হয়েছিল সেখান থেকে পুনঃস্থাপন করা জায়গাটির দূরত্ব কত এ প্রশ্নটি করা হয় এর ভাস্কর মৃণাল হককে। এর উত্তরে তিনি জানান, ‘একেবারে ফিতে দিয়ে তো দূরত্ব মাপা হয়নি। তবে ৩০০ ফুট হবেই। সে হিসাবে দূরত্ব ২০০ হাত হবে।’
হেফাজতে ইসলামের ১০৯ দিনের আন্দোলনের পর ২৫ মে (বৃহস্পতিবার) মধ্যরাতে ভাস্কর্যটি সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে থাকা গ্রিক দেবী থেমিসের ভাস্কর্যটি সরানো হয়। সর্বোচ্চ আদালতের সামনে থেকে ভাস্কর্যটি ২৭ মে (শনিবার) মধ্যরাতে সুপ্রিম কোর্টের পেছনে অ্যানেক্স ভবনের সামনের লনে পুনঃস্থাপন করা হয়। উভয় স্থানের মধ্যবর্তী এই দূরত্ব ২০০ হাতের মতো। ভাস্কর্যটি সরানোর ব্যাপারে হেফাজত এই দাবি করেছিল এ বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি। এর ১০৯ দিন পর ভাস্কর্যটি প্রতিস্থাপন করা হয় সুপ্রিম কোর্টের অ্যানেক্স ভবনের সামনের লনে। ফলে সাধারণ দৃষ্টিতে বলা যায়, হেফাজতের ১০৯ দিনের আন্দোলনে ভাস্কর্যটি সরেছে ২০০ হাত জায়গা।
তবে কতটুকু দূরত্বে সরেছে সেদিকে না তাকিয়ে এটি নিয়ে আরও কঠোর মন্তব্য করেছেন হেফাজতের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক। তিনি বলেছেন, শুধু সুপ্রিম কোর্ট নয়, গ্রিক দেবীর ‘মূর্তিটি (ভাস্কর্য) দেশের কোথাও স্থাপন করা যাবে না। তিনি বলেন, ‘ইতোমধ্যে শুক্রবার বিক্ষোভ ঘোষণা করা হয়েছে। এরপর দেশের আলেমদের নিয়ে হেফাজতের আমির বৈঠক করবেন, পরামর্শ করে পরবর্তী কর্মসূচি আসবে।’
২০১৬ সালের ১৯ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে ভাস্কর্যটি স্থাপন করা হয়। ভাস্কর্যটি স্থাপনের ৪৮ দিনের মাথায় চলতি বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি এটিকে অপসারণের দাবি তোলেন হেফাজতের আমির শাহ আহমদ শফী।
হেফাজতের আমির আহমদ শফী বিবৃতিতে বলেন, ‘বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে এমন মূর্তি স্থাপনের চাহিদা ও সুযোগ কোনোটাই নেই। এটা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য।’ ‘মূর্তি’ অপসারণের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ঈমান, আক্বীদা ও ঐতিহ্য রক্ষার লক্ষ্যে মূর্তি অপসারণের দাবিতে প্রয়োজনে লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় নেমে দুর্বার গণআন্দোলন গড়ে তুলবে।’
আহমদ শফীর বিবৃতির পাঁচদিন পর ১১ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামে সংবাদ সম্মেলন করে ভাস্কর্য সরানোর দাবি করেন হেফাজতের মহাসচিব মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরী। এরপর দেশের অন্যান্য ধর্মভিত্তিক দলগুলো একই দাবিতে ধারাবাহিক কর্মসূচি পালন করে।
হেফাজতের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী বলেন, ‘ফেব্রুয়ারিতে প্রথম বিরোধিতা করে হেফাজত। অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের বক্তব্যের পর আমরা এর প্রতিবাদ করি। আমরা মনে করি, মূর্তি কখনও ন্যায় ও ইনসাফের প্রতীক হতে পারে না।’
প্রসঙ্গত: ১৯ ফেব্রুয়ারি বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেছিলেন, ‘এটা তো মূর্তি না, এটা ভাস্কর্য। এখানে দেখানো হয়েছে তিনটা জিনিস। ন্যায়বিচারের প্রতীক হিসেবে দাঁড়িপাল্লা, দণ্ড বা শাস্তির প্রতীক হিসেবে তলোয়ার এবং নিরপেক্ষ বিচারের প্রতীক হিসেবে চোখ বাঁধা।’
এরপর ১১ এপ্রিল গণভবনে কওমি মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্সের সমমান ঘোষণার সময় ছয়জন শীর্ষ কওমি আলেম ভাস্কর্য বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানান, ভাস্কর্যটি তারও পছন্দ নয়। প্রধানমন্ত্রীর এই মন্তব্যের পর ইসলামী দলগুলোর মনোভাবের পরিবর্তন আসে। ১৫ এপ্রিল জাজেস কমপ্লেক্স উদ্বোধনের পর প্রধানমন্ত্রী নিজেই ভাস্কর্য বিষয়ে প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার সঙ্গে কথা বলেন।
মে মাসের প্রথম থেকেই ইসলামী ঐক্যজোট, ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, খেলাফত আন্দোলনসহ কয়েকটি দল রমজানের মধ্যে ভাস্কর্য না সরালে হরতাল, সুপ্রিম কোর্ট ঘেরাওসহ কঠোর আন্দোলনের হুমকি দেয়। এতে যোগ দেয় ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক আওয়ামী ওলামা লীগও। তারা ভাস্কর্যটি সরাতে ১৫ দিনের আল্টিমেটাম দেয়।
৪৮ দিনের নীরবতার ‘রহস্য’
এদিকে, গত বছরের ১৯ ডিসেম্বর ভাস্কর্য স্থাপন হলেও ধর্মভিত্তিক দল ও সংগঠনগুলো ৪৮ পর কেন নীরব ছিল তার পেছনে ভিন্ন কারণ পাওয়া গেছে। রাষ্ট্রীয় একাধিক সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের শুরু থেকে বিচার বিভাগের সঙ্গে নির্বাহী বিভাগের নানা ধরনের দ্বিমত দেখা দেয়। খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক আ ক ম মোজাম্মেল হকের বক্তব্য, আদালতে তাদের ক্ষমা প্রার্থনা, সংবিধান ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংশ্লিষ্ট নানা ইস্যুতে সরকারের সঙ্গে প্রধান বিচারপতির মতবিরোধ দেখা দেয়।
বিএনপির অভিযোগ, সরকার বিচার বিভাগকে চাপে রেখেছে। একাধিক সংবাদ সম্মেলনে দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ অভিযোগ করেন, ‘সরকার অ্যাটর্নি জেনারেলকে দিয়ে বিচার বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। প্রধান বিচারপতিসহ বিচারপতিদের হুমকি-ধামকি দেওয়ার মধ্য দিয়ে সরকারের রূপ ফুটে উঠেছে।’
গোয়েন্দা সংস্থার সূত্র জানায়, ভাস্কর্য নিয়ে ফেব্রুয়ারিতেই অ্যাটর্নি জেনারেল বক্তব্য দেন। এরপরই এটি সরানোর দাবিতে মাঠে নামে ইসলামী দলগুলো।
সূত্রের ভাষ্য, প্রধান বিচারপতির নানা বক্তব্যে সরকারের মধ্যে চাপ তৈরি হয়। তাই বিচার বিভাগের ওপর চাপ তৈরি করতেই ইসলামী দলগুলোর কর্মসূচিতে সমর্থন ছিল সরকারের। এ কারণে ভাস্কর্য নিয়ে আন্দোলনরত কোনও একটি কর্মসূচিতেও বাধা দেয়নি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
সরকারের একাধিক সূত্র জানায়, ভাস্কর্য সরানো ও প্রতিস্থাপনের মধ্য দিয়ে সরকার রাজনৈতিকভাবে উভয় পক্ষকেই সন্তুষ্ট করতে চেয়েছে।
যদিও হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব মুফতি ফয়জুল্লাহ জানান, ঈমানি দায়িত্ব থেকেই ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে কথা বলছেন তারা। গ্রিক দেবী ন্যায় বা ইনসাফের কোনও প্রতিবিম্ব হতে পারে না। প্রকৃত অর্থে কোরআনই হচ্ছে ন্যায়ের প্রতীক।
হেফাজতের আরেক কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, ‘ঈমানের প্রশ্নে আওয়ামী লীগ, বিএনপি নেই।’
সংগঠনটির কেন্দ্রীয় নেতা আজিজুল হক বলেন, ‘কোনও রহস্য নেই। গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পর আমরা ঈমানি দায়িত্ব পালনে মাঠে নামি।’
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)
একই রকম সংবাদ সমূহ
‘ভোমরা স্থলবন্দরকে পূর্ণাঙ্গ বন্দর করা হবে’ : নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী
সাতক্ষীরা ভোমরা স্থলবন্দর উন্নয়ন ও পরিচালনা গতিশীলতা আনয়নের নিমিত্ত গঠিতবিস্তারিত পড়ুন
টিকাদানের সাফল্যে ‘ভ্যাকসিন হিরো’ পেলেন প্রধানমন্ত্রী
টিকাদানের সাফল্যে ‘ভ্যাকসিন হিরো’ পেলেন প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশে টিকাদান কর্মসূচি একটিবিস্তারিত পড়ুন
সর্বজনীন স্বাস্থ্য কর্মসূচির অগ্রগতি ত্বরান্বিত করার আহ্বান
জাতিসংঘের ৭৪তম সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে নিউ ইয়র্কে এসেবিস্তারিত পড়ুন