সাতক্ষীরায় বর্ষাকাল শেষেও দেখা নেই বৃষ্টির, আমন চাষ ব্যহত
বর্ষাকাল শেষ হতে চললেও কাঙ্খিত বৃষ্টি না হবার কারণে সাতক্ষীরার কৃষকরা পড়েছে চরম বিপাকে। বৃষ্টির অভাবে বীজতলা তৈরী করতে পারেনি জেলার অধিকাংশ কৃষকরা। এতে করে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে আমন চাষ এবং আবাদের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে শংঙ্কা দেখা দিয়েছে। দুই এক দিন ছিটে-ফোটা বৃষ্টি হলেও তা কৃষি ও কৃষকের কোনো কাজে আসেনি।
এদিকে জেলায় পাটের ফলন ভালো হলেও পানির অভাবে পাট পচানো বা জাগ দেওয়া নিয়ে চরম বিপাকে আছেন কৃষকরা। বৃষ্টিপাতের কামনায় জেলার বিভিন্ন এলাকায় ইস্তেস্কার নামাজ আদায় করা হয়েছে।
এদিকে উপকূলীয় এলাকাগুলোতে বৃষ্টিপাত কমে যাওয়া এবং দিন দিন তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়াকে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বলে অভিমত দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
বুধবার (২৪ জুলাই) সাতক্ষীরার সদর উপজেলা বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, পানির জন্য জমিতে চাষ কাজ করতে পারছেন কৃষকরা। এর মধ্যে সদরের রাজার বাগান, মাছখোলা, শাল্যে, আলিপুর, ভোমরা, শিবপুর, লাবসাসহ বিভিন্ন এলাকায় পানির অভাবে ধানের বীজতলা তৈরী করতে পারনেনি কৃষকরা। অনেক কৃষক বাধ্য হয়ে গভীর ও অগভীর নলকূপের মাধ্যমে জমিতে পানি দিয়ে আমনের চারা রোপণ করছেন।
এ বছর বৃষ্টিপাত কম হওয়ার পুকুর, ডোবা জলাশয় ও খাল-বিলে পানি না থাকায় পাট জাগ দিতে না পেরে বাধ্য কোন কোন কৃষক পাশ্ববর্তী নদীতে পাট পচাচ্ছেন।
জেলা আবহাওয়া অফিসের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত মৌসুমের মে মাসে ১৫০ মিলি মিটার বৃষ্টিপাত হয় কিন্তু সেখানে চলতি মৌসুমের মে মাসে মাত্র ১১৭ মিলিমিটার রেকর্ড করা হয়েছে। ২০১৮ সালের জুন মাসে বৃষ্টিপাত হয় ২৫৯মিলিমিটার তার বিপরীতে চলতি মৌসুমে জুন মাসে ২১৮মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। ২০১৮ সালের জুলাই মাসে বৃষ্টিপাত ২৪১মিলিমিটার কিন্তু চলতি মৌসুমের জুলাই মাসের ২২তারিখ পর্যন্ত মাত্র ৭০মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
এদিকে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, গত মৌসুমে জেলায় মোট ৮৭ হাজার ৯০ হেক্টরে রোপা আমন আবাদ করা হয়। এ বছর প্রায় ৯০ হাজার হেক্টর জমিতে রোপা আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। গত বছর জেলায় আমন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮৪ হাজার ৯৫৭ হেক্টর। এর মধ্যে সদর উপজেলায় আবাদ হয়েছে ১৯ হাজার ৫০ হেক্টর জমিতে। এছাড়া কলারোয়ায় ১১ হাজার ৬০০, তালায় ৮ হাজার ৩৯০, দেবহাটায় ৫ হাজার ২৮০, কালীগঞ্জে ১৭ হাজার ৩০, আশাশুনিতে ৯ হাজার ২৪০ ও শ্যামনগরে ১৬ হাজার ৫০০ হেক্টরে আবাদ হয়েছে।
সাতক্ষীরা সদর উপজেলার শাল্যে গ্রামের কৃষক মোখলেছুর রহমান বলেন, ‘একটি বিষয় লক্ষ্য করছি দেশের উত্তরাঞ্চলে ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে বন্যা হচ্ছে। ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে চট্টগ্রামসহ পাহাড়ি এলাকায় পাহাড় ধ্বংসে পড়ছে কিন্তু আমাদের এলাকায় কোন বৃষ্টির দেখা নেই। আগে এই সময় খাল-বিল, পুকুর-নালা পানিতে থই থই করে কিন্তু এবার কোন বৃষ্টির দেখা নেই। চলতি মৌসুমে পাটের ভালো ফলন হয়েছে কিন্তু পানির অভাবে পাট পচানো নিয়ে বিপদে আছি। বর্ষাকাল শেষ হতে গেছে তবুও বৃষ্টির দেখা নেই। সেকেন্ড ব্লক আমন ধান লাগানোর জন্য পাট কেটে ফেলেছি কিন্তু সময় মত তা পচাতে না পারলে নায্য দাম পাওয়া যাবে না। কবে বৃষ্টি হবে আর কবে পাট পচাবো আল্লাহ জানে।’
সদরের রাজার বাগান এলাকার কৃষক আবুল হোসেন বলেন, ‘এবার বৃষ্টির দেখা নেই। বোরো ধান উঠার সাথে সাথে মটরপাম্পও ঘরে এনে রেখেছিলাম। পাওয়ার হাউস থেকে সেই সময় বিদ্যুৎ লাইন কেটে দিয়ে গেছে। নতুন করে লাইন লাগিয়ে আমন চাষ করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। অনেকে মেশিনের মাধ্যমে সেচ দিয়ে বীজতলা লাগিয়েছে তার পরও বলা যাচ্ছে না। পানির অভাবে বীজতলা নষ্ট হচ্ছে। কৃষকেরা ফসল বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন। সেই সঙ্গে কৃষি বিভাগের উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।’
এমনিভাবে সাতক্ষীরার জেলার ৭টি উপজেলায় একই অবস্থা বিরাজ করছে। জেলার আশাশুনি, কালিগঞ্জ শ্যামনগর, দেবহাটা, তালা, কলারোয়া ও সদরের ৭৮টি ইউনিয়ন ও ২টি পৌরসভায় এলাকায় বৃষ্টির অভাবে আমন চাষ ব্যাহত হচ্ছে।
সাতক্ষীরা জেলা জলবায়ু পরিষদের সদস্য সচিব অধ্যাপক আশেক-ই-এলাহী বলেন, ‘আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব উপকুলীয় জেলাগুলোতে পড়া শুরু হয়েছে। বাংলাদেশকে ষড় ঋতুর দেশ বলা হয়। কিন্তু এখন আর ছয়টি ঋতু দেখা যাচ্ছে না। শীতের সময় শীত পড়ছে না। বৃষ্টির সময় বৃষ্টি হচ্ছে না। দেশেরে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের কারণে বন্যা হচ্ছে আবার কোথাও বৃষ্টির দেখা মিলছে না। উন্নত দেশগুলোর কারণে আমাদের আজকের এ অবস্থা। গ্রিন হাউজ ইফেক্টের কারণে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। মেঘ হচ্ছে কিন্তু বৃষ্টি হচ্ছে না। এতে করে উপকূলীয় জেলার কৃষি কাজসহ সকল কাজ ব্যাহত হচ্ছে এবং কৃষকরা আছে চরম বিপাকে।’
সাতক্ষীরা আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জুলফিকার আলী রিপন বলেন, ‘বাংলাদেশে বর্ষাকাল শুরু হয় জুন মাসের প্রথম দিকে। কিন্তু এবার বর্ষা অনেক আগে শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু সাতক্ষীরাসহ দেশের উপকূলীয় এলাকায় সেইভাবে বৃষ্টি হচ্ছে না। এটা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হচ্ছে। মেঘ হচ্ছে কিন্তু তার উপযুক্ত পরিবেশ না থাকায় বৃষ্টি হচ্ছে না। চট্টগ্রাম এবং দেশের উত্তরাঞ্চলে প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, গত মে মাসে জেলায় বৃষ্টিপাতেরর পরিমাণ ছিল ১১৭ মিলিমিটার। জুন মাসে ২১৮ মিলিমিটার এবং জুলাই মাসের ২৮ তারিখ পর্যন্ত ৮০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। বৃষ্টি না হওয়ার কারণে প্রচুর গরম অনুভূত হচ্ছে। তবে বৃহস্পতিবার থেকে জেলা মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভবনা রয়েছে।
সাতক্ষীরা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক অরবিন্দু বিশ্বাস বলেন, ‘চলতি মৌসুমি সাতক্ষীরায় কাঙ্খিত বৃষ্টিপাত না হওয়ায় কৃষকরা আউশ, আমনের বীজতলা ও পাট পচানো নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন সাতক্ষীরার কৃষকরা। বৃষ্টিপাত না হওয়ার কারণে জমি তৈরী করতে সমস্যা দেখা দিচ্ছে বীজতলায় বিভিন্ন রোগের প্রকোপ দেখা দিচ্ছে। যেসব এলাকা সম্পরূক সেচ ব্যবস্থা আছে সে সব এলাকায় সমস্যা হচ্ছে না। কিন্তু যেখানে নেই সেখানে সমস্যা হচ্ছে। তবে এখনও বৃষ্টি হলে আমাদের রোপা আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে।’
প্রসঙ্গত, গত ২২ জুলাই মহান আল্লাহর দরবারে বৃষ্টিপাতের কামনায় কলারোয়া উপজেলার কেঁড়াগাছি ইউনিয়নের কাঁকডাঙ্গা সিনিয়র ফাজিল মাদরাসা সংলগ্ন হেড়ের বিল নামক ফসলি মাঠে সালাতুস ইস্তেস্কার আদায় করেন এলাকাবাসী।
নামাজে অংশ নেয়া মুসল্লিরা জানান, ফজর নামাজের পর পার্শবর্তী কেঁড়াগাছি, কাঁকডাঙ্গা, কুঠিবাড়ি, বাগাডাঙ্গা, গাড়াখালিসহ আশপাশের এলাকা থেকে মুসল্লিরা একত্রিত হতে থাকেন। সেখানে সকলে মিলে ইস্তেস্কার নামাজ আদায় করেন। আষাঢ়-শ্রাবণে প্রচুর বৃষ্টিপাতে কৃষক তার জমিতে ফসল ফলায় কিন্তু চলতি বছর খরা যাওয়ায় কৃষক তাঁর জমিতে চাষাবাদ করতে পারছেন না। কৃষক করতে পারছেন না ধান চাষ, মাছ চাষিরা করতে পারছেন না মাছ চাছ। এজন্য সব শ্রেণি পেশার মানুষ মিলে আল্লাহর রহমতের বৃষ্টি কামনায় দোয়া ও সালাত আদায় করেন। ইস্তেস্কার নামাজে ইমামতি করেন কাঁকডাঙ্গা মাদরাসার অবসরপ্রাপ্ত আরবি প্রভাষক মাওলানা মনিরুল হুদা।
এদিকে গত রবিবার (২১ জুলাই) সকাল ১০ টার দিকে উপজেলার ধলবাড়িয়া ইউনিয়নের মুড়াগাছা এলাকার মুসল্লিদের অংশগ্রহণে মুড়াগাছা বিলে ইস্তিস্কার নামাজ ও দোয়া অনুষ্ঠিত হয়। নামাজ শেষে আল্লাহর কাছে মুসলিম উম্মাহর গুনাহ মাফ ও রহমতের জন্য বর্ষা কামনা করে মোনাজাত করা হয়। নামাজে ইমামতি ও দোয়া পরিচালনা করেন হাফেজ মাওলানা রবিউল ইসলাম।
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)
একই রকম সংবাদ সমূহ
১৪ জুলাই: যবিপ্রবির ল্যাবে সাতক্ষীরা জেলার ৩০ জন করোনা পজিটিভ!
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (যবিপ্রবি) জিনোম সেন্টারে ১৪ জুলাই,২০২০বিস্তারিত পড়ুন
‘প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে সরকার কাজ করছে’: লুৎফুল্লাহ এমপি
সাতক্ষীরা-১ আসনের সংসদ সদস্য এড.মুস্তফা লুৎফুল্লাহ বলেছেন- ‘করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবেও উন্নয়নবিস্তারিত পড়ুন
কলারোয়ার দমদম বাজার মার্কেটের বহুতল ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন
কলারোয়ার দমদম বাজার মার্কেটের বহুতল ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন করা হয়েছে।বিস্তারিত পড়ুন