যে ব্যবস্থাপত্রে রোজা নষ্ট হয় না

ইসলামের পাঁচটি মূল স্তম্ভের মধ্যে রোজা অন্যতম। প্রত্যেক মুসলমানের জন্য রমজানের এক মাস রোজা রাখা ফরজ। এ সময় একজন মুসলমানকে সুবেহ সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত যে কোনো খাদ্যদ্রব্য ও পানীয় গ্রহণ এবং মুখে ওষুধপত্র খাওয়া থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকতে হয়।
অনেক সময় অনেক রোগী একদিকে যেমন রোজা রাখতে চান, তেমনি অন্যদিকে রোগের কারণে বিভিন্ন ওষুধপত্র সেবন করাটাও বাধ্যতামূলক হয়ে দাঁড়ায়, যা না করলে তার জীবন বিপন্নও হতে পারে। রোজা রাখা অবস্থায় অনেক রোগীর পরীক্ষা-নিরীক্ষার বা অস্ত্রোপচারও জরুরি হয়ে পড়তে পারে।
আধুনিক বিজ্ঞানের কল্যাণে অনেক নতুন নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা আবিষ্কৃত হয়েছে, যা আগে ছিল না। যেমন ইনজেকশনের মাধ্যমে ওষুধ দেয়া, ইনহেলার, রক্ত পরীক্ষা, এন্ডোস্কপি, কোলনোস্কপি, বায়োপসি ইত্যাদি।
এর যে কোনোটাই রোজাদার রোগীর জন্য জরুরি হয়ে পড়তে পারে। এ রকম পরিস্থিতিতে অনেক সময় রোগী এবং চিকিৎসক উভয়েই রোজা রাখা না-রাখা নিয়ে দোটানায় পড়েন। এমনকি অনেক চিকিৎসকও সঠিক পরামর্শ দিতে দ্বিধাবোধ করেন।
এ সমস্যাগুলো সামনে রেখে রোজা রাখা অবস্থায় ওষুধ গ্রহণ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ইত্যাদির ব্যাপারে সারা বিশ্বের ইসলামী চিন্তাবিদ ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা তাদের সুচিন্তিত অভিমত দিয়েছেন।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, ইসলামী আলেম-ওলামাদের সঙ্গে কথা বলে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, রোজা থাকা অবস্থায় বেশ কয়েকটি পন্থায় ওষুধ সেবন ও বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলে রোজা নষ্ট হবে না।
১৯৯৭ সালের জুনে মরক্কোতে ‘ইসলামের দৃষ্টিতে সমসাময়িক চিকিৎসা সমস্যা’ (An Islamic Viwe of Certain Contemporary Medical Issues) শিরোনামে একটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। এই সেমিনারের মূল আলোচ্য বিষয় ছিল কী কী মেডিকেলজনিত কারণে রোজার ক্ষতি হয় না।
পরবর্তী সময়ে নবম ফিকাহ-মেডিকেল সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে যৌথভাবে বৈজ্ঞানিক, সাংস্কৃতিক এবং স্বাস্থ্য বিষয়ে আলোচনা হয়। এ আলোচনা যৌথভাবে জেদ্দার ইসলামিক ফিকাহ একাডেমি, মিসরের আল-আজহার ইউনিভার্সিটি, আলেকজান্দ্রিয়ায় অবস্থিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক কার্যালয় এবং ইসলামী শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের (আইএসইএসসিও) উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয়।
এই সেমিনারেও মূল আলোচ্য বিষয় ছিল কিভাবে ওষুধ সেবনে বা পরীক্ষা করলে রোজা ভঙ্গ হয় না।
ইসলামী চিন্তাবিদ ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সর্বসম্মতিক্রমে এমন কয়েকটি সিদ্ধান্ত নেন, যাতে অসুস্থ ব্যক্তি রোজা রাখা অবস্থায় নিন্মলিখিত ব্যবস্থাপত্র নিলে এবং প্রয়োজনে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করালে রোজা ভঙ্গ হবে না। এই সেমিনারের সিদ্ধান্ত ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালে প্রকাশ করা হয়েছে।
* রোজা রাখা অবস্থায় চোখ, কান ও নাকে ড্রপ নেয়া যাবে।
* হৃদরোগীর বেলায় বুকে ব্যথা হলে নাইট্রোগ্লিসারিন স্প্রে বা ট্যাবলেট জিহ্বার নিচে নিতে পারবেন।
* মহিলা রোগীর তলপেটে পরীক্ষার জন্য যোনিদ্বার দিয়ে চিকিৎসক বা নার্স হাতের আঙুল অথবা কোনো যন্ত্র প্রবেশ করালে রোজা ভাঙবে না। এমনকি চিকিৎসার জন্য যোনিপথে পেসারি বা কোনো ওষুধ ব্যবহার করা যাবে।
* মূত্রথলি পরীক্ষা বা এক্স-রে করার জন্য রোগীর প্রস্রাবের দ্বার দিয়ে ক্যাথেটার অথবা অন্য কোনো যন্ত্র প্রবেশ করালে অথবা রেডিও-ওপেক ডাই প্রবেশ করালে রোজা ভঙ্গ হবে না।
* দাঁত তোলা, ড্রিলিং করা বা মেসওয়াক বা ব্রাশ দিয়ে দাঁত পরিষ্কার করা যাবে, তাতে রোজা ভঙ্গ হবে না। তবে যেন এগুলো করার সময় পাকস্থলীতে থুতু বা টুথপেস্ট প্রবেশ না করে।
* রোগীর চামড়া, মাংস, অস্থিসন্ধি ও শিরায় ইনজেকশন দেয়া যাবে। কিন্তু স্যালাইন, ডেক্সট্রোজ, প্রোটিনজাতীয় জিনিস ইত্যাদি ব্যবহার করা যাবে না।
* যে কেউ রক্ত অন্যকে দিতে পারবেন আবার জরুরি প্রয়োজনে নিজেও নিতে পারবেন।
* কোনো রোগী অক্সিজেন অথবা অজ্ঞানকারী গ্যাস (অ্যানেসথেসিয়া) নিলে রোজা ভঙ্গ হবে না।
* ত্বকের মাধ্যমে শরীরের ভেতরে যায় এমন মলম, ক্রিম, অয়েন্টমেন্ট ইত্যাদি ব্যবহার করা যাবে।
* পরীক্ষার জন্য রোগীর শরীর থেকে রক্ত নেয়া যাবে।
* হৃদরোগে আক্রান্ত রোগী হার্টের এনজিওগ্রাম এবং কার্ডিয়াক ক্যাথেটার করা যাবে।
* রোগীর পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য বা চিকিৎসার অংশ হিসেবে এন্ডোস্কপি করলে রোজা ভাঙবে না।
* মুখ পরিষ্কারের জন্য মাউথ ওয়াশ বা গড়গড়া বা মুখে স্প্রে জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করা যাবে, তবে যেন পাকস্থলীতে কোনো কিছু না যায়।
* জরায়ু পরীক্ষার জন্য শরীরে হিস্টারোস্কপি করা যাবে, এমনকি জরায়ুতে কোনো যন্ত্রপাতি বা অন্য কিছু পরীক্ষার জন্য প্রবেশ করালে রোজায় কোনো সমস্যা হবে না।
* লিভার বায়োপসি অথবা অন্য কোনো অঙ্গের বায়োপসি করলে রোজা নষ্ট হবে না।
অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ অনুমোদন করেন, যে-
* নাকে স্প্রে বা হাঁপানি রোগীর বেলায় ইনহেলার জাতীয় কিছু নিলে কোনো সমস্যা নেই।
* রোগীর পায়ুপথে ইনজেকশন অথবা পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য আঙুল বা অন্য কোনো যন্ত্র প্রবেশ করালে রোজা ভাঙবে না।
* জরুরি কোনো অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হলে রোজা রাখা অবস্থায় করা যাবে।
* কিডনি অকেজো হলে রোগীর ডায়ালাইসিস করলে রোজা ভাঙবে না।
লেখক :অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ, ডিন, মেডিসিন অনুষদ, অধ্যাপক, মেডিসিন বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)


একই রকম সংবাদ সমূহ

‘ভোমরা স্থলবন্দরকে পূর্ণাঙ্গ বন্দর করা হবে’ : নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী
সাতক্ষীরা ভোমরা স্থলবন্দর উন্নয়ন ও পরিচালনা গতিশীলতা আনয়নের নিমিত্ত গঠিতবিস্তারিত পড়ুন

টিকাদানের সাফল্যে ‘ভ্যাকসিন হিরো’ পেলেন প্রধানমন্ত্রী
টিকাদানের সাফল্যে ‘ভ্যাকসিন হিরো’ পেলেন প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশে টিকাদান কর্মসূচি একটিবিস্তারিত পড়ুন

সর্বজনীন স্বাস্থ্য কর্মসূচির অগ্রগতি ত্বরান্বিত করার আহ্বান
জাতিসংঘের ৭৪তম সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে নিউ ইয়র্কে এসেবিস্তারিত পড়ুন