বিশেষ কলাম...
‘মহান মে দিবস’ :: প্রফেসর মো. আবু নসর
১মে শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের সংগ্রামের স্মারক দিবস হিসেবে সারা বিশ্বে পালিত হয়। মে দিবসের একটি ক্ষুদ্র অথচ গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস আছে।
ঊনিশ শতকের শেষার্ধ পর্যন্ত শ্রমিকদের ছিল না কোন ন্যায্য মজুরীর নিশ্চয়তা, ছিল না নির্দিষ্ট সময়ের সীমা পরিসীমা। মালিকরা তাদের খেয়াল খুশি মতো শ্রমিকদের ১২ থেকে ১৬ ঘন্টা পর্যন্ত খাটাতো। ১৮৭৭ থেকে ন্যায্য মজুরী, ৮ঘন্টা কর্ম দিবস ও অন্যান্য দাবি আদায়ের লক্ষ্যে শ্রমিকরা ব্যাপক ধর্মঘট পালন করে। আন্দোলনের বিরুদ্ধে পুলিশ লেলিয়ে দেয়া হয়। গুলিতে ১৮৮৪সাল পর্যন্ত ৩’শ শ্রমিক নিহত হয়।
আজ থেকে ১৩১ বছর পূর্বে ১৮৮৬ সালের ১মে’র এই দিনে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে অগনিত শ্রমজীবী মানুষ শ্রমিক নিপীড়ণের বিরুদ্ধে গড়ে তুলেছিলেন এক অতুলনীয় আন্দোলন। সেই দিন যুক্তরাষ্ট্রের ১১হাজার ৫’শ ৬২টি শিল্প কারখানাসহ সব শিল্পাঞ্চলে ৮ঘন্টা কাজের দাবিতে ধর্মঘটের ডাক দেয় শ্রমিকরা। শিকাগো শহরের ‘হে’ মার্কেটে রূপ নেয় লাখো শ্রমিকের বিক্ষোভের সমুদ্রে। শহরের ৩লক্ষাধিক মেহনতি শ্রমিক কাজ বন্ধ রেখে লাল ঝান্ডা হাতে নিয়ে নেমে আসেন রাস্তায়। এসময় আন্দোলনরত ক্ষুব্ধ শ্রমিকদের উপর বিনা উস্কানিতে নির্বিচারে গুলি চালায় পুলিশ। পুলিশের গুলিতে ওই দিন-ই নিহত হন ১০জন শ্রমিক, আহত হন হাজার হাজার শ্রমিক। তবু অব্যাহত থাকে ধর্মঘট ও আন্দোলন।
এরপর ৩মে ‘রিপার’ কারখানার সামনে শ্রমিক সভায় পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান আরো ৬শ্রমিক। এসব হত্যার প্রতিবাদে ৪মে শিকাগোর ‘হে’ মার্কেট স্কয়ারে স্মরণাতীতকালের বিশাল শ্রমিক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
সমাবেশে আবারো বর্বরোচিত হামলা চালায় পুলিশ। ওই ঘটনায় ৪জন শ্রমিক ও ৭জন পুলিশ নিহত হয়। আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার অপরাধে গ্রেফতার করা হয় বহু শ্রমিককে। গ্রেফতারকৃত ৬জন শ্রমিককে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড প্রদান করা হয়। কারাগারে বন্দিদশায় আত্মহনন করেন এক শ্রমিক। আর কারাগারে আটকে রেখে নির্মম নির্যাতন করা হয় হাজার হাজার শ্রমিককে। দাবি আদায়ের জন্য সেদিন শ্রমিকদের বুকের তাজা রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল শিকাগোর রাজপথ।
‘হে’ মার্কেটের শ্রমিকদের আত্মত্যাগ ও রক্তস্নাত প্রতিরোধ যুদ্ধে এবং আন্দোলনের মধ্য দিয়ে দৈনিক কাজের সময় ৮ঘন্টা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের ঐতিহাসিক বিজয় সম্ভব হয়। দীর্ঘদিন বঞ্চনা আর শোষন থেকে মুক্তি পেতে অধিকার আদায়ের সংগ্রামে ১৩১ বছর আগের এই দিনে শ্রমিকরা বুকের রক্ত ঝরিয়ে সৃষ্টি করেছিলেন এক অপর উপখ্যান। অবশেষে দৈনিক ৮ঘন্টা কাজের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয় তৎকালীন যুক্তরাষ্ট্র সরকার।
১৮৮৯ সালের ১৪জুলাই ফ্রান্সের প্যারিসে অনুষ্ঠিত ২য় আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোর রক্তঝরা অর্জনকে স্বীকৃতি দিয়ে ‘১মে’কে ঘোষনা করা হয় ‘আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবস’ হিসেবে। এই সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে ১৮৯০ সাল থেকে প্রতি বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পালিত হয়ে আসছে ‘মে দিবস’।
১মে ঐতিহাসিক ‘মে দিবস’। মহান ‘মে দিবস’ শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের দিন। বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের আন্তর্জাতিক সংহতি প্রকাশের দিন। একই সাথে মনে রাখতে হবে যে- দেশ ও জাতির উন্নয়নে শ্রমিকদের মর্যাদা অতি আবশ্যক। শ্রমিকদের মর্যাদা ব্যতীত দেশ ও জাতির উন্নয়ন সাধিত সম্ভব নয়। আমাদের দেশেও যথাযোগ্য মর্যাদা ও গুরুত্ব সহকারে ‘মে দিবস’ পালিত হয়ে আসছে। কিন্তু আজো শ্রমিকদের সার্বিক কল্যাণ সুনিশ্চিত হয়নি। শ্রমিক স্বার্থ সংরক্ষণ ব্যতীত শিল্পের বিকাশও সম্ভব নয়।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে- গত ২০১৩ সালের ২৪এপ্রিল বাংলাদেশের সাভারের রানা প্লাজা ভবন ও পোশাক তৈরি কারখানা ভবন ধসে কয়েক শতাধিক পোশাক শ্রমিকের মর্মান্তিক মৃত্যু ও প্রাণহানির ধ্বংসস্তুপ এবং গুরুতর আহত হয়ে অসংখ্যা শ্রমিকদের মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ার ঘটনা, ২০০৫সালের ১১এপ্রিল সাভারের পলাশবাড়ির শাহরিয়ার ফেব্রিক্স ইন্ডাস্ট্রিজ লি. ও স্পেকট্রাপ সোয়েটার ইন্ডাস্ট্রিজ লি. এর ভবন ধসে ৬২জন শ্রমিকের প্রাণহানি, ২০১০ সালের ১জুন ঢাকার তেজগাঁও এলাকার বেগুনবাড়িতে ভবন ধসে ২৫জনের মৃত্যু ২০১২ সালের নভেম্বরে আশুলিয়ার তাজরিন গার্মেন্টস ভবনে অগ্নিকান্ডে অগ্নিদগ্ধ হয়ে প্রায় ১’শত শ্রমিকের মৃত্যু, আশুলিয়ার প্রাণকেন্দ্রের একটি ভবন ধসে কয়েকজনের মৃত্যু এবং গাজিপুরসহ দেশের বহু এলাকায় অনেক শ্রমিকের প্রাণহানির মতো হৃদয়বিদারক ঘটনা আমাদের নিদারুন ভাবে শোকাহত ও বেদনাহত করে তুলেছে। সকল শ্রমিকদের অনাকাঙ্খিত মৃত্যুতে ব্যথিত ও শোকাহত সমগ্র জাতি।
বস্তুত: বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নতির মূলে আছেন এ’দেশের সৃজনশীল গরীব শ্রমিক। শ্রমিকের জীবন নিয়ে টানাহেচড়া যেমন কারোরই কাম্য নয় তেমিন শ্রমিক বান্ধব হওয়াও বাঞ্চনীয়। পরিবহন শ্রমিক, পোশাক শ্রমিক, বিভিন্ন শিল্প-কারখানার শ্রমিকসহ ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ সকল কর্মযজ্ঞতায় নিয়োজিত সকল শ্রমিকদের সামগ্রিক স্বার্থ ও সঠিক মর্যাদা রক্ষার্থে সংশ্লিষ্ট মালিক পক্ষকে সকল গাফিলতির ঊর্দ্ধে উঠে এসে শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরী প্রদানসহ শ্রমিকসেবা নিশ্চিত ও তরান্বিত করা একান্ত প্রয়োজন। তবেই হবে মহান ‘মে দিবস’ এর অঙ্গীকার পূরণ এবং ‘মে দিবস’র যথার্থতা ও স্বার্থকতা।
লেখক:
প্রফেসর মো. আবু নসর
অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ, কলারোয়া সরকারি কলেজ, সাতক্ষীরা।
প্রাক্তন কলেজ পরিদর্শক, যশোর শিক্ষা বোর্ড।
প্রাক্তন ডেপুটি রেজিস্ট্রার, নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)
একই রকম সংবাদ সমূহ
‘ভোমরা স্থলবন্দরকে পূর্ণাঙ্গ বন্দর করা হবে’ : নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী
সাতক্ষীরা ভোমরা স্থলবন্দর উন্নয়ন ও পরিচালনা গতিশীলতা আনয়নের নিমিত্ত গঠিতবিস্তারিত পড়ুন
টিকাদানের সাফল্যে ‘ভ্যাকসিন হিরো’ পেলেন প্রধানমন্ত্রী
টিকাদানের সাফল্যে ‘ভ্যাকসিন হিরো’ পেলেন প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশে টিকাদান কর্মসূচি একটিবিস্তারিত পড়ুন
সর্বজনীন স্বাস্থ্য কর্মসূচির অগ্রগতি ত্বরান্বিত করার আহ্বান
জাতিসংঘের ৭৪তম সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে নিউ ইয়র্কে এসেবিস্তারিত পড়ুন