নড়াইলের নেতা মাশরাফি বিন মর্তুজাকে কৌশিক নামেই ডাকতাম!
নড়াইলের মাশরাফি ও রাহির স্কুলবেলা। মাশরাফির সঙ্গে শরীফ শাহরিয়ার জিকো। মাশরাফি বিন মর্তুজাকে আমরা কৌশিক নামেই ডাকতাম। প্রাইমারি থেকে একসঙ্গে লেখাপড়া করেছি এসএসসি পর্যন্ত। মাশরাফির বাড়ি আর নানাবাড়ি আমাদের বাড়ি থেক বড়জোর তিন মিনিটের পথ। স্কুলে যাওয়া আর খেলা ধুলাসবই একসঙ্গে। লম্বা ছিপ ছিপে গড়ন আর মাথায় কোঁকড়া চুলের ছেলেটা লেখাপড়ায় খুব মনোযোগী না থাকলেও মেধায় কারো চেয়ে কম ছিল না। ক্লাসে রেজাল্টও খারাপ করত না।
ক্লাস সিক্সে নড়াইল সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর দুই বন্ধু পড়লাম দুই সেকশনে, আমি ‘ক’ শাখায় আর কৌশিক ‘খ’ শাখায়। ওই সময়ে দুই শাখা আলাদা টিম করে টিফিনের সময় স্কুলের পাশে ঈদগাহ মাঠে টেনিস বল দিয়ে মেতে থাকতাম ক্রিকেট খেলায়। দুই দলের দলনেতা ছিলাম আমরা দুজন। সে সময় চাঁদা তুলে কালো কাঠের শিল্ড তৈরি করে পুরস্কার দেওয়া হতো বিজয়ী দলের হাতে।
ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকেই স্যারদের হাতে মার খাওয়া শুরু। ওই সময় আমাদের স্কুলের দুইজন লুত্ফর স্যার ছিলেন। ছোট লুত্ফর স্যার অঙ্ক ক্লাস নিতেন। স্যার ক্লাসে পাঁচটি অঙ্ক দিয়ে বলতেন, ৫০ বার করে তাঁকে দেখাতে হবে। অনেকে ফাঁকি দিয়ে এক-দুই পাতা করে নিয়ে স্যারকে দেখিয়ে আনত। অনেক সময়ই স্যার সম্পূর্ণ না দেখে প্রথম পৃষ্ঠায় সাইন করে দিতেন, মাঝেমধ্যে দু-একজনের খাতা সম্পূর্ণ দেখতেন। একবার কৗশিক ধরা খেয়ে গেল। স্যার দেখলেন, ও এক অঙ্ক মাত্র দুইবার করেছে। স্যার ওকে বেশ মারলেন বেত দিয়ে।
আমার বাড়িতে লোকজন থাকত না, তাই টিফিনে আমরা কয়েক বন্ধু আমাদের বাড়িতে চলে আসতাম। আমাদের ঘরের সঙ্গেই একটি বড় পেয়ারাগাছ ছিল, কৌশিক সবার আগে তরতর করে গাছে উঠে যেত। আমরা নিচের ডালে থাকলেও কৌশিক একেবারে ওপরের আর কোনার দিকে চিকন ডালে গিয়ে পেয়ারা পেড়ে খেত। আমাদেরও দিত। টিফিনের সময় পার হয়ে গেলেও গাছ থেকে না নেমেই বলেছে, তোরা স্কুলে যা, আমি নদীতে যাচ্ছি গোসল করতে।
তখন আমরা ক্লাস এইটে পড়ি। ফাইনাল পরীক্ষা কয়েক দিন বাদেই। আমাদেরই বন্ধু পলাশ আর রুমন এসে জানাল, কাল গোবরা স্কুল মাঠে টেপ টেনিস প্রতিযোগিতা। গোবরার হয়ে আমাদের খেপ খেলতে হবে। পরদিন খেলা, আবার স্কুলেও যেতে হবে। কী করা যায়—এটা ঠিক করতে বিকেলে খেলা শেষে মিটিং হলো। সিদ্ধান্ত হলো, সকালে স্কুলের ব্যাগ নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে আসতে হবে, পরে স্কুল পালিয়ে খেলতে যাব। যথারীতি পরদিন কৌশিক স্কুলে এলো। স্কুলের এক পাশে আমার বাড়ি আর কৌশিকের বাড়ি অন্য পথে। স্কুলে ঢোকার আগে দুই বন্ধুর দেখা। স্কুলের সামনের রাস্তার পাশে বটগাছতলায় আজমির ভাইয়ের দোকান। কৌশিক, আমি, রুমন, পলাশ, সাজু, রাজুসহ অন্যরা স্কুলের ব্যাগ আজমির ভাইয়ের দোকানে রেখে ভ্যানে উঠে রওনা দিলাম গোবরায়। খেলা শেষে স্কুলে আসতে বিকেল প্রায় ৫টা বেজে গেছে। এদিকে কৌশিকের খোঁজে ওর মা আর মামা স্কুলের গেটে হাজির। আমাদের স্কুলে না পেয়ে আজমির ভাইয়ের কাছে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, আমরা খেলতে গেছি। ভ্যানে স্কুলের গেটে পৌঁছার আগেই দেখি মাশরাফির মা বলাকা খালা লাঠি নিয়ে দৌড়ে আসছেন। মাশরাফি এটা দেখে চলন্ত ভ্যান থেকে নেমে দৌড়।
একদিন আমরা ক্লাসের বাইরে স্কুলের ভেতরের মাঠে শহীদ মিনারের পাশে হৈ-হুল্লোড় করছি সবাই মিলে। লুত্ফর স্যার আমাদের ওই অবস্থায় দাবড়ে নিয়ে যান নতুন ভবনের তিন তলায়, তারপর রুমের দরজা আটকে ইচ্ছামতো মারলেন হাতের ডাস্টার দিয়ে। সেদিন কৌশিকসহ আমরা প্রায় সবাই স্যারের মার খেয়েছিলাম।
স্কুলে আসার পর থেকেই আমরা শুধু খেলা নিয়ে বেশি ভাবতাম। এক ক্লাস থেকে অন্য ক্লাসের ফাঁকে কিংবা ক্লাসে স্যার আসতে দেরি করলেই শুরু হতো ক্রিকেট নিয়ে আলাপ। কৌশিকের কাছে ব্যাগের মধ্যে টেনিস বল থাকত। ক্লাসের ভেতরেই ভাঙা বেঞ্চের পায়া দিয়ে ব্যাট বানিয়ে খেলা শুরু হয়ে যেত।
আমাদের স্কুলের মাঠের সঙ্গেই লাগানো চিত্রাবাণী সিনেমা হল। নতুন সিনেমা এলে স্কুল পালিয়ে সিনেমা দেখতে চলে যেত ছেলেরা। তখন আমরা নাইনে পড়ি, আমাদের ক্লাসটিচার ছিলেন বিপুল পাঠক স্যার। স্কুলে প্রথম দুটি ক্লাস করেই কৌশিক চলে যায় সিনেমা দেখতে, সঙ্গে বন্ধু রাজু, প্রলয়সহ চার-পাঁচজন। পরদিন প্রথম ক্লাসে স্যারের কাছে কারা যেন নালিশ করেছিল। স্যার কৌশিককে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন—কাল কি স্কুল পালিয়ে সিনেমা দেখতে গিয়েছিলে? মিথ্যা জবাব না দিয়ে সে সত্য বলে মাথা নাড়ল, আর স্যারও মারলেন দলনেতা কৌশিককে।
ক্লাস নাইনে ওঠার পর ও মানবিক বিভাগে চলে যায়, আমি বিজ্ঞান বিভাগে। আমাদের ক্লাস ভিন্ন হলেও কমন সাবজেক্টগুলোয় একসঙ্গে বসতাম। স্কুলে প্রতিদিনই নিয়ম করে আসত, এসেই আলাপ জুড়ে দিত কোথায় কোন খেলা হচ্ছে। ফুটবল আর ক্রিকেট, দুটির প্রতিই ওর টান। কৌশিকের চমত্কার বন্ধুসুলভ আচরণ আমাকে সব সময়ই টানত। স্কুলের মাঝের বেঞ্চে বসত কৌশিক, মাঝেমধ্যে আমিই প্রথম বেঞ্চ থেকে ওর কাছে গিয়ে বসতাম। দুই ক্লাসের গ্যাপে আমাদের কয়েকজনকে ডেকে কৌশিক বিভিন্ন এলাকার খেলা ও খেলোয়াড়দের গল্প শোনাত আর শোনাত ওকে ক্রিকেট খেলার সরঞ্জাম কে কী কিনে দিল—এইসব। ও তখন ক্রিকেটে পুরোপুরি ঝুঁকে পড়েছে।
আমরা তখন ক্লাস নাইনে পড়ি। দোতলায় আমাদের ক্লাসরুমটা একেবারে স্কুলের মাঠের কোনায়। মাশরাফি বসত মাঠের দিকের বেঞ্চে। ক্লাসে ইংরেজি পড়াতে এসেছেন বিপুল স্যার। স্যার অত্যন্ত গম্ভীর ও কড়া। তাঁর পড়া মুখস্থ না করে স্কুলে গেলে মার খেতে হতো। স্যার ক্লাসে ইংরেজি পড়াচ্ছেন আর মাশরাফি মাঠে ক্রিকেট খেলা দেখছে। তখন আমাদের মাঠে নিয়মিত বড়দের ম্যাচ হতো। মাশরাফি এক মনে খেলা দেখছে, আর উত্তেজনায় ছটফট করছে। স্যার ক্লাসে অমনোযোগী মাশরাফিকে ধমক দিয়ে বললেন, ‘এই মাশরাফি বল তো, আমি কী পড়ালাম।’ ও তড়িঘড়ি করে বলল, ‘স্যার স্যার ছক্কা’—এই জবাবে ক্লাসের সবাই হো হো করে হেসে উঠল। পরে স্যারের ধমকে আমরা আবার পড়ায় মনোযোগ দিলাম।
আমার মনে আছে, আমরা প্রথম ক্লাস করে রোল কল হয়ে যাওয়ার পর বাথরুমের কথা বলে বের হতাম। তারপর বাথরুমের পাশের দেয়াল টপকে স্কুল পালাতাম। ছুটে চলে যেতাম কৌশিকের নানাবাড়ির পাশের বাগানে। সেখানে একটি গাছকে স্টাম্প বানিয়ে প্রতিদিন ক্রিকেট খেলতাম, আবার টিফিন পিরিয়ডে ক্লাসে ঢুকতাম, না হলে স্কুলের টিফিন খাওয়া যাবে না।
স্কুলের বার্ষিক ভোজ কিংবা ঈদে মিলাদুন্নবী যেকোনো অনুষ্ঠানে আমাদের মধ্যে সে-ই সব কাজে এগিয়ে থাকত। ক্লাস নাইনে পড়ার সময় আমরা যখন স্কুলের নানা বিষয়ে নেতৃত্ব দিয়েছি, আমাদের নেতা ছিল কৌশিক। একবার স্কুলের বার্ষিক ভোজে খবর পাওয়া গেল, স্যাররা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে দই দেবেন না। এ কথা শোনার পর কৌশিককে বলা হলো এটা কেমন খাওয়া হবে। পরে সে আমাদের বলল, ‘চল স্যারের কাছে যাই।’ প্রধান শিক্ষক আলী আহম্মদ স্যারের কাছে দাবি উত্থাপন করা হলো। স্যার অনেক চেঁচামেচির পর দই খাওয়াতে রাজি হলেন।
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)
একই রকম সংবাদ সমূহ
কলারোয়ায় ফুটবল টুর্নামেন্টে ফাইম একাদশ, গদখালি ও পাথরঘাটা সেমিতে
কলারোয়ায় ৮দলীয় ফুটবল টুর্নামেন্টে ১ম, ২য় ও ৩য় খেলায় ফাইমবিস্তারিত পড়ুন
কলারোয়ার কেঁড়াগাছিতে প্রীতি ফুটবল ম্যাচে মাধবকাটিকে হারালো স্বাগতিকরা
কলারোয়ার কেঁড়াগাছিতে এক প্রীতি ফুটবল ম্যাচে সাতক্ষীরা সদরের মাধবকাটি ফুটবলবিস্তারিত পড়ুন
সাতক্ষীরায় বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্নামেন্টের সমাপনী ও পুরস্কার বিতরণ
সাতক্ষীরায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা শেখবিস্তারিত পড়ুন