এমডিদের পদ রক্ষায় কাজে আসছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুরক্ষানীতি
গত তিন বছরে বেসরকারি ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড থেকে পদত্যাগ করতে হয়েছে তিনজন ব্যবস্থাপনা পরিচালককে (এমডি)। পরিচালনা পর্ষদে পরিবর্তনের কারণে চাপের মুখে এ বছর চাকরি হারাতে হয়েছে দুজন এমডিকে। পর্ষদের চাহিদা পূরণ করতে না পারায় সর্বশেষ গত ২০ নভেম্বর পদত্যাগ করতে হয়েছে মেঘনা ব্যাংকের এমডি মোহাম্মদ নূরুল আমিনকেও। গুঞ্জন আছে, পরিস্থিতির কারণে পদ হারাতে হতে পারে আরো একাধিক ব্যাংকের এমডিকে।
ব্যাংক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সুরক্ষায় ২০১৪ সালের ২৩ ডিসেম্বর পরিপত্র জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ‘ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীর নিযুক্তি ও দায়দায়িত্ব সম্পর্কিত বিধিবিধান’ শীর্ষক ওই নীতিমালা অনুযায়ী, কোনো ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীকে পরিচালনা পর্ষদ অপসারণ অথবা তিনি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করতে চাইলেও ‘প্রকৃত কারণ উল্লেখপূর্বক’ কমপক্ষে এক মাস আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে অবহিত করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া নিয়োগ চুক্তি বাতিল কিংবা প্রধান নির্বাহীকে পদত্যাগে বাধ্য করানো যাবে না। যদিও চলতি বছর ব্যাংকগুলোর এমডি ও প্রধান নির্বাহীদের পদত্যাগের ক্ষেত্রে এর কোনোটিই মানা হয়নি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের ব্যাংকগুলোয় অনেক মৌলিক বিধান উপেক্ষিত হলেও রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক নমনীয় থেকেছে। এতে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনায় থাকা শীর্ষ ব্যক্তির চাকরিও নড়বড়ে অবস্থার মধ্যে পড়ছে। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর চেয়ারম্যানসহ পরিচালকদের ক্ষমতা বাড়ছে। এর বিপরীতে ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় দুর্বল হচ্ছে এমডিদের কর্তৃত্ব।
এ নিয়ে বেসরকারি খাতের অন্তত ১০টি ব্যাংকের এমডির সঙ্গে কথা হয়। ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় নিজেদের কর্তৃত্ব হারানোর কথা স্বীকার করেছেন তাদের প্রায় সবাই। তারা বলছেন, চেয়ারম্যান বা পর্ষদ সদস্যদের অযাচিত চাহিদার বিপরীতে গেলেই পদ হারানোর ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। যদিও পদে থাকা অবস্থায় এমডিদের কেউই আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দিতে চাননি।
পর্ষদ নিয়ে মন্তব্য করতে চাননি ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি আনিস এ খানও। বণিক বার্তার পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে তিনি শুধু বলেন, দেশের আর্থিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ব্যাংকিং খাতে সুশাসন আরো বাড়ানো প্রয়োজন। এমডিদের কাজ করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক যে ধরনের নীতিমালা দিয়েছে, সেভাবে কাজ করতে দেয়া উচিত। এর বাইরে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ সম্পর্কে আমরা কোনো মন্তব্য করতে পারি না।
তবে ব্যাংকের এমডিরা পর্ষদের কাছে নয়, বরং যেকোনো কাজের জন্য তারা পুরোপুরি বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে দায়বদ্ধ বলে মনে করেন বেসরকারি ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার। এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে থাকা এ উদ্যোক্তা বলেন, এমডিরা তাদের প্রতিটি কাজের জন্য পর্ষদের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য নন। তাদের জবাবদিহিতার জায়গা হলো বাংলাদেশ ব্যাংক। সুতরাং পর্ষদের অনৈতিক দাবি এমডিরা শুনবেন বা মানবেন কেন? পরিচালকরা অন্যায় আবদার করলে এমডি বাংলাদেশ ব্যাংকে অভিযোগ করবেন। অন্যায় করতে বাধ্য করার চেষ্টা করলে এমডিরা পদত্যাগ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেন। কারণ ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় এমডিরা সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী।
চাকরিজীবনের শেষ সময়ে সাউথইস্ট ব্যাংক ছেড়ে চলতি বছরের ২৯ অক্টোবর সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের (এসআইবিএল) এমডি পদে যোগদান করেছিলেন সহিদ হোসেন। মাত্র সাত মাস দায়িত্ব পালনের পর গত ৩০ অক্টোবর এসআইবিএলের এমডি পদ থেকে পদত্যাগে বাধ্য হন তিনি। মূলত ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদে পরিবর্তনের অংশ হিসেবেই এমডি পদ থেকে সহিদ হোসেনকে পদত্যাগ করতে হয়। এক্ষেত্রে বিদ্যমান এমডি সুরক্ষানীতি পুরোপুরি উপেক্ষিত হয়েছে।
গতকাল সহিদ হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, দীর্ঘ ব্যাংকিং জীবনে স্বাধীনভাবে কাজ করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু এখন যে যেখানে আছেন, নিজের চাকরি বাঁচানোর চেষ্টা করছেন। ব্যাংকের এমডি পদটিকে ধর্মীয় অনুভূতির মতো করে নিতে হবে। একটি ব্যাংকে লাখো মানুষের আমানত থাকে। সে আমানতের যথার্থ রক্ষণাবেক্ষণ একটি পবিত্র দায়িত্ব। অনিয়ম হলে তাতে দুই পক্ষেরই অংশগ্রহণ থাকে। তবে এসআইবিএল থেকে পদত্যাগের বিষয়ে আমার কোনো অভিযোগ নেই।
২০১৩ সালে যাত্রা করা মেঘনা ব্যাংকে এমডি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন মোহাম্মদ নূরুল আমিন। পর্ষদের সঙ্গে বোঝাপড়ায় ঘাটতি তৈরি হওয়ায় ২০ নভেম্বর পদত্যাগ করেন তিনি। যদিও আগামী বছরের শেষ পর্যন্ত মেয়াদ ছিল তার।
কোন পরিস্থিতিতে পদত্যাগ করেছেন? এমন প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে গেলেও তিনি বলেন, ব্যাংকগুলোর এমডিদের সুরক্ষার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ। বাংলাদেশের বাস্তবতা সম্পূর্ণ। এখানে স্বাধীনভাবে কাজ করা কঠিন। বহু আইন ও নীতিমালা আমাদের দেশে আছে। তবে ‘বোকারা আইন মানবে, চালাকদের মানতে হবে না’, এমন একটি নীতি এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে।
এসআইবিএলে এমডি পদ শূন্য হলে চলতি বছরের শুরুত্বে ব্যাংকটিতে এমডি পদে নিয়োগ পেয়েছিলেন ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবি) অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম শহিদুল ইসলাম। কিন্তু ইউসিবি পর্ষদ তাকে নিজ ব্যাংকের এমডি পদে নিয়োগ দেয়ার কথা বলে ছাড়তে চায়নি। পরে ইউসিবি পর্ষদ শহিদুল ইসলামকে এমডি পদে নিয়োগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিলেও শেষ পর্যন্ত তিনি যোগদান করতে পারেননি। পরে তিনি ইউসিবি ছেড়ে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকে এএমডি পদে যোগদান করেন।
সাম্প্রতিক সময়ে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর পর্ষদে অপ্রত্যাশিত রদবদল হাওয়ায় আগামী কয়েক মাসে বেশ কয়েকজন এমডিও চাকরি হারানোর আশঙ্কা করছেন।
এ পরিস্থিতিকে মোটেও স্বাভাবিক মনে করেন না ঢাকা ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, এমডিদের সুরক্ষায় বাংলাদেশ ব্যাংক যে নীতিমালা করেছে সেটি ভালো। তবে কোনো ব্যাংকের পর্ষদ যদি এমডির সঙ্গে কাজ করতে না চায়, তাহলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুরক্ষাকবচ তার জন্য কাজে আসে না। এটিই বাস্তবতা।
তবে এমডিদের সুরক্ষার বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয় বলে জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা। তিনি বলেন, ব্যাংকগুলোর আর্থিক সুশাসন নিশ্চিত করা ও প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ডে পর্ষদের হস্তক্ষেপ নিয়ন্ত্রণ করতে অনেক আগেই বাংলাদেশ ব্যাংক একটি নীতিমালা দিয়েছে। সেটি ঠিকমতো অনুসরণ হচ্ছে কিনা, তাও পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। তাছাড়া প্রত্যেকটি ব্যাংকের পর্ষদ, নির্বাহী কমিটি, অডিট কমিটিসহ সব কমিটির বৈঠকের পর্যালোচনা ও সিদ্ধান্তগুলো আমাদের কাছে আসে। ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডার, পরিচালক, ব্যবস্থাপক ও আমানতকারীদের স্বার্থের বিষয়টি আমরা সবসময়ই পর্যবেক্ষণের চেষ্টা করি। এর পরও কিছু ঘটলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়।
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)
একই রকম সংবাদ সমূহ
‘ভোমরা স্থলবন্দরকে পূর্ণাঙ্গ বন্দর করা হবে’ : নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী
সাতক্ষীরা ভোমরা স্থলবন্দর উন্নয়ন ও পরিচালনা গতিশীলতা আনয়নের নিমিত্ত গঠিতবিস্তারিত পড়ুন
টিকাদানের সাফল্যে ‘ভ্যাকসিন হিরো’ পেলেন প্রধানমন্ত্রী
টিকাদানের সাফল্যে ‘ভ্যাকসিন হিরো’ পেলেন প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশে টিকাদান কর্মসূচি একটিবিস্তারিত পড়ুন
সর্বজনীন স্বাস্থ্য কর্মসূচির অগ্রগতি ত্বরান্বিত করার আহ্বান
জাতিসংঘের ৭৪তম সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে নিউ ইয়র্কে এসেবিস্তারিত পড়ুন