বায়ান্ন’র ভাষা সৈনিক শেখ আমানুল্লাহ স্যারের স্মৃতিচারণ
ভাষার আন্দোলনের মাস ফেব্রুয়ারি। বছর ঘুরে আসে আমাদের মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠার মাস এ মাস। আমাদের মাঝে আর দৃশ্যমান হন না বরেণ্য ভাষা সৈনিক শেখ আমানুল্লাহ। যিনি আমাদের চেতনায় রয়েছেন। তাঁকে ছাড়াই এই ষষ্ঠবারের মতো আমরা বিন¤্র শ্রদ্ধায় পালন করবো আন্তজার্তিক মাতৃভাষা দিবস। তিনি প্রয়াত হয়েছেন ছয় বছর। তাঁকে আর আমরা পাবো না। তবে তিনি চিরদিনই থাকবেন আমাদের চেতনায় ও স্মৃতিতে অম্লান হয়ে। আলহাজ্ব শেখ আমানুল্লাহ ছিলেন আমাদের সবার শিক্ষাগুরু। তিনি যৌবনের সোনালি দিনগুলোতে মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে শুধু সোচ্চার ছিলেন না, নেতৃত্ব দিয়েছেন একেবারে সামনে থেকে। বায়ান্ন’র মহান ভাষা আন্দোলনের সূচনালগ্নের উত্তাল দিনগুলোতে তিনি এর সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন। তিনি আজও আমাদের চেতনায় সমুজ্জ্বল। আলহাজ্ব শেখ আমানুল্লাহকে এদেশের মানুষ এক নামে জানেন একজন বিদগ্ধ শিক্ষক নেতা হিসেবে। শিক্ষকদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে সারাটা জীবন তিনি নিজেকে বিলীন করে দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি যে একজন ভাষা সৈনিক, তা অনেকটা রয়ে গেছে ইতিহাসের আড়ালে।
জানা যায়, শেখ আমানুল্লাহ ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখা সাতক্ষীরা জেলার অন্যতম এক সৈনিক ছিলেন। সর্বজন শ্রদ্ধেয় এই ভাষা সৈনিকের বায়ান্ন’র সেই উত্তাল দিনগুলোর সাহস ও বীরত্বের কথা অনেকেই জানেন না। প্রচার বিমুখ এই ভাষা সৈনিককে এ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার প্রয়োজন মাতৃভাষা আন্দোলনের ইতিকথা জানানোর জন্যই। ১৯২৯ সালের ৫ জুলাই সাতক্ষীরার কলারোয়ার ঝাঁপাঘাট গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন শেখ আমানুল্লাহ। ২০০৬ সালের এক সাক্ষাৎকারে শেখ আমানুল্লাহ জানিয়েছিলেন, ১৯৪৮ সালে যশোর এম এম কলেজে একাদশ শ্রেণিতে অধ্যয়নরত অবস্থায় তিনি ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেন। সে সময়ের এই ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন আলমগীর সিদ্দিকী, আফসার আহম্মেদ সিদ্দিকী, রনজিৎ কুমার, হামিদা বানু, শেখ আমানুল্লাহসহ ছাত্র নেতৃবৃন্দ। তিনি জানিয়েছিলেন, ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ এম এম কলেজ থেকে একটি মিছিল এসে জমায়েত হয় তদানিন্তন ট্রেডিং ব্যাংক ময়দানে। সেখানে উপস্থিত বক্তারা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠা করার দৃঢ় শপথ ব্যক্ত করেন। ওই একই বছরের ১৪ মার্চ কেন্দ্রীয় সংগ্রাম পরিষদের ডাকা সাধারণ ধর্মঘট চলাকালে স্কুল-কলেজের বিপুল সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রীর সাথে যোগ দেন সাধারণ জনতা।
যশোর কালেকটরেট ভবনের সামনে অনুষ্ঠিত হয় বিশাল গণ সমাবেশ। সমাবেশ পন্ড করতে পুলিশ লাঠিচার্জ ও গুলিবর্ষণ করে। এতে আলমগীর সিদ্দিকী গুলিবিদ্ধ হয়ে মারাত্মক আহত হন। পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন অনেক নেতা-কর্মী। সারা দেশের মধ্যে সে সময়ে যশোরেই প্রথম ভাষা আন্দোলন ঠেকাতে পুলিশ গুলিবর্ষণ করে। ৪৮ থেকে ৫২’র একুশে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ভাষার দাবিতে সংঘটিত দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সবগুলো আন্দোলন-সংগ্রামে শেখ আমানুল্লাহ অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন। ভাষার আন্দোলনে অবদান রাখা এই মানুষটির প্রকৃত স্বীকৃতি তাঁর জীবদ্দশায় সেভাবে মেলেনি। নতুন প্রজন্ম জানে না ভাষার জন্য লড়াকু এই মানুষটির সংগ্রামের কাহিনি। বেঁচে থাকাকালীন একুশ’র বিভিন্ন আলোচনা সভায় শেখ আমানুল্লাহ বক্তৃতার মাধ্যমে তুলে ধরতেন তাঁর জীবনের অনেক পাওয়া না পাওয়ার কথা। আর কোনোদিন এ প্রজন্ম শুনতে পাবে না তাঁর সেই উদাত্ত কন্ঠের প্রত্যয়ী বাণী। ২০১৩ সালের ৩১ আগস্ট বেলা ১২ টার দিকে ঢাকা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে মত্যুবরণ করেন কিংবদন্তি ভাষা সৈনিক শেখ আমানুল্লাহ। ভাষা সৈনিক শেখ আমানুল্লাহ বিশ্বাস করতেন, বাঙালি জাতির যা কিছু অর্জন, তার মূলে হলো একুশের চেতনা। ভাষা আন্দোলনই বাঙালির সকল আন্দোলন-সংগ্রাম ও অর্জনের পটভূমি। মাতৃভায়ায় কথা বলার রাষ্ট্রীয় অধিকার হলো একুশের শ্রেষ্ঠ অর্জন। একুশের পথ বেয়েই এসেছে মহান মুক্তিযুদ্ধ। বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ পেয়েছে একটি স্বাধীন ভূখন্ড, একটি মানচিত্র আর সবুজের বুকে রক্তখচিত জাতীয় পতাকা। ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারায় তিনি গর্ব বোধ করতেন।
কেননা, এই আন্দোলনই দিয়েছে মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার। বিশ্বের ১৮৯টি দেশে একযোগে পালিত হয় এ দিবসটি। তাই এ গৌরব বাংলাদেশের। এ গৌরব ভাষাশহিদদের। জীবদ্দশায় একুশের কয়েকটি অনুষ্ঠানে শেখ আমানুল্লাহ আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ভাষা আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী হিসেবে আজও পাইনি উল্লেখ করার মত কোনো স্বীকৃতি। এরপরও কেউ ভাষা সৈনিক বললে বুকটা এক অন্য ধরনের গর্বে ভরে যায়। শেখ আমানুল্লাহ প্রত্যাশা করতেন, তৃতীয় শ্রেণি থেকে স্নাতক পর্যন্ত বাংলা পাঠ্য বইয়ের একটি প্রবন্ধ ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে অন্তর্ভূক্ত থাকা দরকার। তিনি মনে করতেন, তাহলে একুশের চেতনা ধারণ করেই একজন শিক্ষার্থী বেড়ে উঠতে পারবে। কলারোয়ার বে-সরকারি অনেক কলেজ ক্যাম্পাসে শহিদ মিনার গড়ে না উঠায় শেখ আমানুল্লাহ তাঁর জীবদ্দশায় উদ্বেগ প্রকাশ করতেন। সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহিদ মিনার স্থাপনের ওপর তিনি গুরুত্ব আরোপ করতেন। ভাষা সৈনিক প্রয়াত শেখ আমানুল্লাহ’র সৃষ্টিশীল কর্মময় জীবনাদর্শে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম দেশপ্রেম-ভাষাপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হবে, এমনটি প্রত্যাশা ভাষাপ্রেমীদের। তাঁর নামে কলারোয়ায় গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠান ‘শেখ আমানুল্লাহ ডিগ্রী কলেজ’ আজ দক্ষিণাঞ্চলের শীর্ষ কলেজগুলোর মধ্যে অন্যতম। এছাড়া মানুষের শ্রদ্ধায় ও উপলব্ধিতে প্রয়াত শেখ আমানুল্লাহ’র অবস্থান ছিলো, আছে এবং থাকবে।
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)
একই রকম সংবাদ সমূহ
১৪ জুলাই: যবিপ্রবির ল্যাবে সাতক্ষীরা জেলার ৩০ জন করোনা পজিটিভ!
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (যবিপ্রবি) জিনোম সেন্টারে ১৪ জুলাই,২০২০বিস্তারিত পড়ুন
‘প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে সরকার কাজ করছে’: লুৎফুল্লাহ এমপি
সাতক্ষীরা-১ আসনের সংসদ সদস্য এড.মুস্তফা লুৎফুল্লাহ বলেছেন- ‘করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবেও উন্নয়নবিস্তারিত পড়ুন
কলারোয়ার দমদম বাজার মার্কেটের বহুতল ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন
কলারোয়ার দমদম বাজার মার্কেটের বহুতল ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন করা হয়েছে।বিস্তারিত পড়ুন