দৃষ্টি এখন ইসির দিকে
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) তিনমাস ব্যাপী ধারাবাহিক সংলাপ শেষ। এখন সবার দৃষ্টি ইসির দিকে। আগামীতে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য কমিশন কী কী পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে তা জানার অপেক্ষায় সবাই। যদিও নির্বাচন কমিশন এখনও তাদের করণীয় বিষয়গুলো সুনির্দিষ্ট করেনি। সংলাপ থেকে পাওয়া সুপারিশগুলোর সারসংক্ষেপ প্রস্তুত এবং এসবের গ্রহণযোগ্যতা যাচাই-বাছাইয়ের কাজ চলমান রয়েছেন। এই অবস্থায় আজ বৃহস্পতিবার সকাল ১১টায় আগারগাঁও নির্বাচন ভবনে সংলাপ পরবর্তী প্রেস ব্রিফিংয়ের আয়োজন করেছে ইসি। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নূরুল হুদা সংলাপে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতা সংবাদ সম্মেলনে তুলে ধরার পাশাপাশি আগামীতে করণীয় বিষয়গুলো সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা দেয়ার চেষ্টা করবেন।
নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সংলাপের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোসহ সংশ্লিষ্ট সব মহলের কাছ থেকে যে সাড়া পেয়েছে, যতটুকু আস্থা অর্জন করেছে তা অব্যাহত রাখতে পরবর্তী পদক্ষেপ গুলোতে সাহসী ও সতর্ক ভূমিকা রাখতে হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইসি কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব হেলালুদ্দীন আহমেদ বলেন, সংলাপের সবগুলো প্রস্তাব একত্রিত করে শীগ্রই বই আকারে প্রকাশ করা হবে। প্রস্তাবগুলো সমন্বয় করে সব দলের কাছে পাঠানো হবে। যে সব প্রস্তাব এসেছে কমিশন সভায় উত্থাপণের পর সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হবে। সংলাপ পরবর্তী বিষয়ে বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলবেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার।
ইসি সূত্র জানায়, ক্ষমতাসীন দল আগামী সংসদ নির্বাচনে ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ‘ইভিএম’ ব্যবহারের প্রস্তাব দিয়েছে যা আগামী নির্বাচনে বাস্তবায়ন সম্ভব না। এছাড়াও কমিশনের এখতিয়ার বর্হিভূত বেশকিছু প্রস্তাব এসেছে সংলাপে। বিশেষ করে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার এবং সংসদ ভেঙ্গে দেয়ার প্রস্তাব। এই প্রস্তাবের বিষয়ে আইনগতভাবে কমিশনের কিছুই করার নেই।
এ বিষয়ে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার এটিএম শামসুল হুদার মতে, আইন যেগুলি আছে এগুলোকে অভিজ্ঞতার আলোকে নির্বাচন কমিশনের এখতিয়াভুক্তগুলো এবং তাদের এখতিয়ারের বাইরেরগুলো বাছাই করে করনীয় ঠিক করতে হবে। নির্বাচনকালীণ সরকারের বিষয়ে ইসি তো পরিবর্তন আনতে পারে না। কেননা, এটা পিউরলি রাজনৈতিক দলগুলোর বিষয়।
নির্বাচন কমিশন ইতোমধ্যেই সংলাপে উত্থাপিত কয়েকটি প্রস্তাব নিয়ে কাজ শুরু করেছে। গত ২৩ অক্টোবরের সংলাপে নারী নেত্রীরা সেসব দল সর্বস্তরের কমিটিতে ৩৩ শতাংশ নারী প্রতিনিধিত্ব রাখার বিধান বাতিলের প্রস্তাব দিয়েছে তাদের নিবন্ধন বাতিলের দাবি জানায়। একই সাথে এধরণের নারী এবং একই সাথে সংবিধান বিরোধী নীতি দলগুলোর গঠনতন্ত্রেও রয়েছে কিনা তা কমিশনকে যাচাই করতে বলে। কমিশন এ বিষয়ে খতিয়ে দেখা শুরু করেছে। গত ২৪ অক্টোবরের সংলাপে সাবেক নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ আবদুল মোবারক নির্বাচনী আইন সংষ্কারের জন্য লিখিতভাবে বেশ কিছু প্রস্তাব রাখেন। এসব প্রস্তাবের মধ্যে নির্বাচনে সেনা নিয়োগের বিষয়টিও রয়েছে। মোহাম্মদ আবদুল মোবারকের যুক্তি গণপ্রতিপ্রতিনিধিত্ব আদেশে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সংজ্ঞায় প্রতিরক্ষা বাহিনীকে অন্তর্ভুক্ত না করেও কার্যকরভাবে সেনা সহযোগিতা পওয়া সম্ভব। এক্ষেত্রে তিনি সিআরপিসি’র ১৩১ ধারা উল্লেখ করে বলেছেন, এই বিধানের বলে প্রয়োজনে ম্যাজিট্রেটের অনুপস্থিতেও সেনাবাহিনীর একজন কমিশন্ড অফিসারও জননিরাপত্তার জন্য ক্ষতিকর অবৈধ সমাবেশ ভঙ্গের নির্দেশ দেয়ার ও অপরাধীদের গ্রেপ্তারের অধিকার রাখেন। এ প্রস্তাবটি কমিশনারদের মধ্যে আলোচনায় রয়েছে।
সংলাপের বিষয়ে জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, এই সংলাপের ফলাফল বা সফলতা নির্ভর করে নির্বাচন কমিশনের উপর। নির্বাচন কমিশন সবার কথা শুনল। এখন তাদেরই দায়িত্ব সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য, প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন করা। তার প্রেক্ষিতে এখন তারা (নির্বাচন কমিশন) সিদ্ধান নেবে কোনগুলো তারা গ্রহণ করবে, কোনগুলো করবে না। তবে এই সংলাপে বিদ্যমান রাজনৈতিক বিরোধ মিটবে না। এর সমাধান রাজনৈতিকভাবেই করতে হবে।
ফিরে দেখা সংলাপ
একাদশ সংসদ নির্বাচনের কর্মপরিকল্পনা নিয়ে নির্বাচন কমিশনের সাথে গত ৩১ জুলাই প্রথম সংলাপ হয় সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সাথে। সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের বেশিরভাগই নির্বাচনে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অংশ হিসেব সেনাবাহিনী নিয়েগের ব্যবস্থা নিতে বলেছেন। তাঁরা বলেছেন ১৫ ফেব্রুয়ারি ও ৫ জানুয়ারির মত একপাক্ষিক নির্বাচন আমরা আর দেখতে চাই না। ঢালাওভাবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বীতায় নির্বাচন প্রতিরোধে ‘না’ ভোটের বিধান পুনর্বহালেরও দাবি জানান তাঁরা। এছাড়া ইসির নিজস্ব কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে রিটার্নিং অফিসার নিয়োগ, সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া, প্রার্থীদের হলফনামায় দেয়া তথ্য যথাযথভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষা করা, অভিযোগ দ্রুত নিস্পত্তি করা, প্রশাসন ঢেলে সাজানো, মনোনয়ন বাণিজ্য নজরদারিতে রাখা, প্রবাসীদের ভোটার করার সুপারিশও করেন তাঁরা। এছাড়া প্রস্তাবও দেন নির্বাচনের সময় সংসদ ভেঙ্গে দেয়ার। এরপর গত ১৬ ও ১৭ আগস্ট গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের সাথে সংলাপ হয়। এ সংলাপে নির্বাচনে সকল দলের অংশগ্রহন নিশ্চিত করতে নির্বাচন কমিশনকে তাদের সাংধিানিক ক্ষমতা কঠোরভাবে প্রয়োগের আহ্বান জানিয়ে বলা হয়, কমিশনকে রিয়েল রোল প্লে করতে হবে। সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর যেভাবে চাইবে, সেইভাবে নির্বাচন আয়োজন করতে হবে। ভোটারদের আস্থা অর্জনের ব্যবস্থা করতে হবে। এজন্য এখন থেকেই লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরিতে পদক্ষেপ নিতে হবে। নির্বাচন কমিশনকে সব দল ও ভোটারের আস্থা অর্জনের পরামর্শ দিয়ে তাঁরা বলেন, বর্তমান কমিশন এখন মাত্র টেস্ট প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে।
গত ২৪ আগস্ট থেকে ১৯ অক্টোবার পর্যন্ত ৪০টি নিবিন্ধিত রাজনৈতিক দলের সাথে সংলাপে বসে ইসি। দলগুলো নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা ও সেনা নিয়োগ বিষয়ে প্রায় সব দলই নিজেদের মতামত বা প্রস্তাব রাখে। সে তুলানায় সীমানা পুনর্নিধারণ, না ভোটের বিধান চালু, ইভিএম-এর ব্যবহার ও নির্বাচনী আচরণ বিধি সম্পর্কে সব দলের মতামত পাওয়া যায়নি। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ও অন্যান্য নির্বাচন সংক্রান্ত আইন বাংলায় রুপান্তরের বিষয়ে অনেক দলেরই সমর্থন মিলেছে। দুটি দল নির্বাচনে প্রার্থীর ব্যক্তিগত ৮ তথ্যসহ হলফনামা দাখিলের বিধান বাতিল চেয়েছে। নির্বাচন কর্মকর্তাদেরকেই রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব দেয়া, প্রবাসীদের ভোটাধিকার দেয়া এবং সংসদে নারী আসনের সংখ্যা বাড়িয়ে সরাসরি নির্বাচনের ব্যবস্থা করার পরামর্শ দেয় বেশ কয়েকটি দল।
দুই মেরুতে দলগুলো :
নির্বাচন কর্মকর্তাদের মতে, কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা ও সেনা নিয়োগ বিষয়ে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর বেশিরভাগই দুই মেরুতে বিভক্ত। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটের শরীক দলগুলো বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রীর অধীনই নির্বাচন চায়। নির্বাচনে বিশেষ ক্ষমতা দিয়ে সেনা নিয়োগেরও বিপক্ষে এ জোটের শরীকরা। অন্যদিকে দেশের প্রধান বিরোধীদল বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটেরসহ গত নির্বাচনে অংশ না নেয়া দলগুলোসহ বেশিরভাগই সংসদ ভেঙ্গে দিয়ে এবং বিশেষ ক্ষমতাসহ সেনা নিয়োগের পক্ষে। ৪০টি দলের মধ্যে গণপ্রতিনিধিত্ব আইন-এ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত করে এবং ম্যাজিস্টেরিয়াল ক্ষমতাসহ সেনা মোতায়েনের প্রস্তাব রেখেছে বিএনপিসহ ২৫টি দল। বর্তমান সংসদে বিরোধীদল জাতীয় পার্টিও সেনা মোতায়েনের পক্ষে। বিদ্যমান আইনের বাইরে সেনা মোতায়েনের বিপক্ষে আওয়ামী লীগসহ ৯টি দল। এ বিষয়ে স্পষ্ট কোন মতামত নেই বা বিষয়টি নির্বাচন কমিশনের উপর ছেড়ে দিয়েছে ৬টি দল। ইভিএম চালুর পক্ষে প্রস্তাব রাখে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ ৬টি দল। এর বিপক্ষে ১২টি দল। বাকি ২০ দলের এ বিষয়ে স্পষ্ট কোন মতামত পাওয়া যায় নি
সংসদ ভেঙ্গে সহায়ক বা নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন চায় ২০টি দল। এর বিপক্ষে বিদ্যমান সংবিধান অনুসারে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর অধীনেই নির্বাচন চায় ৯টি দল। এ বিষয়ে ভিন্ন ধরণের প্রস্তাব রয়েছে বা স্পষ্ট কোন মতামত নেই ১১ টি দলের। এরপর গত ২২, ২৩ ও ২৪ অক্টোবর নির্বাচন পর্যবেক্ষক, নারী নেত্রী ও সাবেক নির্বাচন কমিশনারসহ প্রশানের সাবেক কয়েকজন কর্মকর্তার সাথে সংলাপে বসে ইসি। সংলাপে নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলোর প্রধানরা নিজেরাই তাদের কারো সঙ্গে কোন রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা রয়েছে কি না তা খতিয়ে দেখতে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) তাগিদ দেন। শেষ দিনে সাবেক নির্বাচন কমিশনারদের পক্ষ থেকে বলা হয়, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে বড় বাধা বিশৃঙ্খলা। একটি নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠান করা নির্বাচন কমিশনের জন্য চ্যালেঞ্জ হলেও সে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সংলাপের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে অর্জিত আস্থা ধরে রাখতে হবে।
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)
একই রকম সংবাদ সমূহ
‘ভোমরা স্থলবন্দরকে পূর্ণাঙ্গ বন্দর করা হবে’ : নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী
সাতক্ষীরা ভোমরা স্থলবন্দর উন্নয়ন ও পরিচালনা গতিশীলতা আনয়নের নিমিত্ত গঠিতবিস্তারিত পড়ুন
টিকাদানের সাফল্যে ‘ভ্যাকসিন হিরো’ পেলেন প্রধানমন্ত্রী
টিকাদানের সাফল্যে ‘ভ্যাকসিন হিরো’ পেলেন প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশে টিকাদান কর্মসূচি একটিবিস্তারিত পড়ুন
সর্বজনীন স্বাস্থ্য কর্মসূচির অগ্রগতি ত্বরান্বিত করার আহ্বান
জাতিসংঘের ৭৪তম সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে নিউ ইয়র্কে এসেবিস্তারিত পড়ুন