ভয়াল ২১ আগস্ট আজ
আজ ২১ আগস্ট। বঙ্গবন্ধু এভিনিউ এ আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলার ১৫ বছর। ২০০৪ সালের এই দিনে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালায় হরকাতুল জিহাদের (হুজি-বি) একদল জঙ্গি। যা ছিল ছয় বছর ধরে এ জঙ্গিগোষ্ঠীর হামলা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার ধারাবাহিক চেষ্টার এক চূড়ান্ত রূপ। বাংলাদেশের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত নৃশংস সহিংসতার যেসব ঘটনা ঘটেছে এ ঘটনা তার একটি।
সেদিন শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের শীর্ষ স্থানীয় কয়েকজন নেতা অল্পের জন্য এ ভয়াবহ হামলা থেকে বেঁচে গেলেও প্রাণ হারান দলের ২৪ জন নেতাকর্মী। এ ছাড়া এ হামলায় আরো ৪০০ জন আহত হন। আহতদের অনেকেই চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেছেন। তাদের কেউ কেউ আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি।
হুজির হামলা ও হত্যাযজ্ঞ
১৯৯৯ সালের মার্চ থেকে ২০০৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ছয় বছরে এই জঙ্গিগোষ্ঠী দেশে ১৩টি বোমা ও গ্রেনেড হামলা চালায়। এতে ১০৬ জন নিহত হন। আহত হন ৭০০র বেশি মানুষ। আওয়ামী লীগ ও সিপিবির সমাবেশ, উদীচী ও ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান, ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও ব্রিটিশ হাইকমিশনারের ওপর এসব হামলা হয়। এই সময়ের মধ্যে আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনাকেই হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে অন্তত চার দফা।
২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২১ আগস্ট মামলার নতুন করে তদন্তের উদ্যোগ নেয়। এরপর বেরিয়ে আসতে থাকে অনেক অজানা তথ্য। এরপর ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে এক বছরের মধ্যে হুজি-বির প্রায় সব শীর্ষস্থানীয় নেতা ও গুরুত্বপূর্ণ জঙ্গি গ্রেফতার হয়। শীর্ষ জঙ্গিনেতা মুফতি হান্নানসহ তিনজনের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে।
আফগানফেরত মুজাহিদদের গড়া সংগঠন হুজি-বি এ দেশে জঙ্গিবাদের গোড়াপত্তন করেছিল। বাংলাদেশ থেকে যেসব ব্যক্তি তৎকালীন সোভিয়েত বিরোধী যুদ্ধে অংশ নিতে গিয়েছিলেন, তাদের বেশির ভাগই এর সঙ্গে যুক্ত হন। তারা ছিলেন কওমি মাদরাসায় শিক্ষিত। সংগঠনের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের অনেকে পাকিস্তানের বিভিন্ন মাদরাসায় লেখাপড়া করেছিলেন। ১৯৯২ সালে ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ করার পর ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত ছিল হুজি-বির বিস্তারপর্ব।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৯৯৮ সালের পর থেকে হুজি-বি রোহিঙ্গাদের থেকে মনোযোগ সরিয়ে এ দেশের ভেতরে নাশকতামূলক তৎপরতা শুরু করে। লক্ষ্যবস্তু করে প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল ও সংগঠনকে। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের (১৯৯৬-২০০১) শেষ তিন বছর হুজি-বির জঙ্গিরা আটটি বড় ধরনের বোমা হামলা চালিয়েছিল। তখন তিন দফা শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা চালায় এই জঙ্গিরা। এর মধ্যে প্রথম চেষ্টা হয়েছিল ২০০০ সালের জুলাইয়ে; গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় প্রধানমন্ত্রীর জনসভাস্থল ও হেলিপ্যাডের কাছে দূরনিয়ন্ত্রিত দুটি শক্তিশালী বোমা পুঁতে রেখে। কোটালীপাড়ায় হত্যার পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ার পর ২০০১ সালের ৩০ মে খুলনায় রূপসা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল হুজি। কিন্তু তিন দিন আগে ২৭ মে সেতুর কাছাকাছি রূপসা নদী থেকে দুটি ইঞ্জিন নৌকাভর্তি ১৫ জঙ্গি ধরা পড়ে যাওয়ায় সেটিও আর সফল হয়নি। এই ১৫ জনের একজন মাসুম বিল্লাহ ওরফে মুফতি মইন ঢাকায় ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় অংশ নিয়েছিলেন। বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসার পর এই মামলার কোনো অগ্রগতি হয়নি। গ্রেফতার হওয়া সবাই কিছুদিন পর জামিনে বেরিয়ে যান।
এরপর ২০০১ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর সিলেটে নির্বাচনী জনসভায় হত্যার পরিকল্পনা করেন হুজির জঙ্গিরা। কিন্তু শেখ হাসিনা সিলেট পৌঁছান নির্ধারিত সময়ের অনেক পর। জনসভা ছিল সিলেট শহরের আলিয়া মাদরাসা মাঠে। তিনি সভাস্থলে পৌঁছার পর রাত আটটার দিকে কাছাকাছি এলাকায় একটি মেস ঘরে জঙ্গিদের তৈরি বোমা কোনো কারণে বিস্ফোরিত হয়ে যায়। শেখ হাসিনা তখন সভামঞ্চে ছিলেন। এ ঘটনায় ঘটনাস্থলে দুই জঙ্গি নিহত হন। আহত অবস্থায় হুজি-বির দুই সদস্য মাসুদ আহমেদ (শাকিল) ও আবু ওবায়দা গ্রেফতার হন। তখন আসামি মাসুদ আহমেদ আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়ে ঘটনার বিবরণ দিলেও কিছুদিন পর পুরো বিষয়টি ধামাচাপা পড়ে যায়। পরে ২০০৬ সালের ৫ অক্টোবর ও ১৯ নভেম্বর হুজির দুই গুরুত্বপূর্ণ নেতা মাওলানা আবু সাইদ ও মুফতি হান্নানের দেয়া জবানবন্দিতে এই হত্যাচেষ্টার কথা বলেন। পরে এই ঘটনার নতুন করে তদন্ত শুরু হয়।
২০০০ সালে কোটালীপাড়ায় বোমা পুঁতে রাখার ঘটনার পর হুজি-বি ও এর অন্যতম নেতা মুফতি আবদুল হান্নানের নাম আলোচনায় আসে। এরপর ২০০১ সালের ২০ জানুয়ারি ঢাকার পল্টনে সিপিবির সমাবেশে, ১৪ এপ্রিল রমনার বটমূলে বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে, ৩ জুন গোপালগঞ্জের বানিয়ারচর ক্যাথলিক গির্জায়, ১৬ জুন নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে বোমা হামলা ও ব্যাপক প্রাণহানির পরও এই জঙ্গিদের আইনের আওতায় আনতে সক্ষম হয়নি তখনকার সরকার।
২০০১ সালের অক্টোবরে বিএনপি ক্ষমতায় আসে। তারাও এসব মামলার সুষ্ঠু তদন্তের উদ্যোগ নেয়নি। উল্টো ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার তদন্ত ভিন্ন খাতে নেয়ার চেষ্টা করে। ২০০৭ সালে এক-এগারোর পটপরিবর্তনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসে ২১ আগস্ট মামলার নতুন করে তদন্ত শেষে অভিযোগপত্র দেয় এবং বিচার শুরু করে।
এদিকে যখন হুজি-বির বিষয়ে উদাসীনতা বা তাদের কার্যক্রম ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা চলছিল, সেই সুযোগে দেশে আত্মপ্রকাশ করে নতুন এক জঙ্গিগোষ্ঠী জেএমবি। হুজি হানাফি মাজহাব হলেও জেএমবি সম্পূর্ণ সালাফি মতাদর্শী। এই গোষ্ঠীটি ২০০১ সাল থেকে বিভিন্ন এলাকায় সিনেমা হল, যাত্রা অনুষ্ঠান, মাজার ও বিভিন্ন এনজিওতে হামলা শুরু করে।
২০০৪-০৫ সালে এর মাত্রা অনেক বেড়ে যায়। তখনো এদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। উপরন্তু ২০০৪ সালে রাজশাহীতে চরমপন্থী দমনের নামে বাংলা ভাইয়ের নেতৃত্বে জেএমবির (তখন ‘জাগ্রত মুসলিম জনতা’ নাম ব্যবহার করেছিল) তৎপরতায় স্থানীয় পুলিশের সহযোগিতা ছিল। তখন বিএনপির কয়েকজন মন্ত্রী ও সাংসদের বিরুদ্ধে এই জঙ্গিদের পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ ওঠে। ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশব্যাপী সিরিজ বোমা হামলার পর বিএনপি সরকার জেএমবি দমনে অভিযান শুরু করলেও হুজি-বির বিষয়ে শেষ পর্যন্ত নির্লিপ্তই থেকে যায়।
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)
একই রকম সংবাদ সমূহ
ট্রাম্পের হয়ে প্রচারণা চালানো মোদি’র তা ভারতের পররাষ্ট্রনীতির পরিপন্থী
২০২০ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে সামনে রেখে বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ডবিস্তারিত পড়ুন
ছাত্রদলের কাউন্সিল: ৮ভোটে হেরে গেলেন কেশবপুরের সেই শ্রাবণ
জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কাউন্সিলে সভাপতি পদে মাত্র ৮ ভোটে হেরে গেছেনবিস্তারিত পড়ুন
ছাত্রদলের নতুন সভাপতি খোকন, সম্পাদক শ্যামল
কাউন্সিলরদের প্রত্যক্ষ ভোটে নতুন নেতৃত্ব পেল বিএনপির সহযোগী সংগঠন ছাত্রদল।বিস্তারিত পড়ুন