কলম থেকে কলাম
পৃথিবীর ফুসফুস আমাজন বনাঞ্চলে আগুন : দায় কার?
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় রেইন ফরেস্ট আমাজন।প্রতি বছর এখানে প্রায় ২০০ সে.মি. বৃষ্টিপাত সংগঠিত হয়। জঙ্গলটি পৃথিবীর সবচেয়ে আর্দ্র জায়গাগুলোর একটি। কিন্তু শুধুমাত্র ২০১৯ সালেই আমাজন জঙ্গলের ব্রাজিল অংশে ৭৪,১৫৫টি আগুনের ঘটনা ঘটেছে।
আর্দ্র এ জঙ্গলে এতো বেশি পরিমাণ আগুনের ঘটনা সংগঠিত হচ্ছে কেন? একটি রেইন ফরেস্টে এতো বেশি দাবানলের ঘটনা মোটেও যুক্তিসংগত নয়।জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত আমাজন অঞ্চল শুষ্ক থাকে। এই সময়গুলোতে আগুন লাগার ঘটনা নতুন কিছু নয়।
তবে, এই বছর আগুনের ঘটনা নজিরবিহীন। বর্তমানে, ২,৫০০ এরও বেশি স্থানে আগুন জ্বলেছে। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা আমাজন জঙ্গলে আগুন লাগার তিনটি কারণ চিহ্নিত করেছেন।
প্রথম কারণ-বন উজাড়। ঘরবাড়ি নির্মাণ, কৃষি কাজের সম্প্রসারণ, খনিজ পদার্থ অনুসন্ধান সহ বিভিন্ন উদ্দেশ্যে গাছপালা কেটে বন উজাড় করছে মানুষ। কেটে ফেলা গাছ নিশ্চিহ্ন করার সবচেয়ে ভালো কৌশল কিছুদিন রোদে শুকিয়ে গাছগুলোকে পুড়িয়ে ফেলা। আর পুড়িয়ে ফেলার সময় সেই আগুনই ছড়িয়ে পড়ছে আশেপাশের জঙ্গলে।
দ্বিতীয় কারণ হল- কৃষি উৎপাদন ও কৃষিভূমি সম্প্রসারণ। কৃষিভূমি এবং গবাদি পশুর চারণভূমি তৈরি করতে জঙ্গলে সরাসরি আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে মানুষ। ডাব্লিউ. ডাব্লিউ.এফ এর মতে, বন উজাড়ে যে সকল ক্ষেত্রে যন্ত্র ব্যর্থ,সেখানেই দেয়া হচ্ছে আগুন।
তৃতীয় কারণ – খরা ও প্রাকৃতিক দূর্যোগ। বিজ্ঞানীরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন খরার তীব্রতাকে চরম পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে। খরা রীতিমতো একটি দুষ্টচক্র তৈরি করেছে। পানি স্বল্পতায় জঙ্গলের গাছ শুকিয়ে যাচ্ছে। শুষ্ক গাছে আগুন লেগে দাবানল সৃষ্টি হয়ে আরো বৃক্ষনিধন ঘটছে। ফলে বাড়ছে খরার তীব্রতাও।
তিনটি কারণের সম্মিলন ফায়ার-প্রুফ রেইন ফরেস্টকে আগুনের কুন্ডলীতে পরিণত করেছে। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জাইর বলসোনারো জানুয়ারিতে ক্ষমতায় আসার পর থেকে আমাজনে আগুনের ঘটনা বেড়ে গেছে।
২০১৮ থেকে ২০১৯ সালের ব্যবধানে আগুনের ঘটনা ৮৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
এন. জি. ও গুলো বলছে, ব্রাজিলের বর্তমান সরকার অর্থনৈতিক মন্দাবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে জঙ্গল উজাড়ে উৎসাহ দিচ্ছে।অন্যদিকে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট বলসোনারো উল্টো এন. জি. ও গুলোকেই বনে আগুনের জন্য দায়ী করছেন।
আমাজন পৃথিবীর ২০% অক্সিজেন সরবরাহ করে এবং এক-চতুর্থাংশ কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে।আমাজন জঙ্গলের প্রয়োজনীয়তা শুধুমাত্র ব্রাজিল বা দক্ষিণ আমেরিকার রাষ্ট্রগুলোর জন্য নয়। আমাজন জঙ্গল বিনাশ হলে বৈশ্বিক উষ্ণতা চিরতরে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। শিল্পোন্নত দেশগুলো শীর্ষে রয়েছে কার্বন নির্গমনেও। বাড়তি অক্সিজেন সরবরাহের বিনিময়ে উন্নত দেশগুলো দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোকে কতটা বাণিজ্যিক সহায়তা দিয়েছে? কৃষির জন্য বন উজাড় করা মানুষদের ভাগ্য উন্নয়নে পাশে দাঁড়িয়েছে উন্নত দেশগুলো।
আমাজন জঙ্গলে আগুন লেগে বনাঞ্চল হ্রাস ও উষ্ণতা বৃদ্ধির পাশাপাশি ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র্য। প্রকৃতিকে ধ্বংস করে আমাজন জঙ্গলে যা ঘটানো হচ্ছে তা অত্যন্ত বর্বর এবং নিষ্ঠুর। কিন্তু, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য যারা দায়ী,দায়বদ্ধতাও তাদের সবচেয়ে বেশি নয় কী? মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন,” বৈশ্বিক উষ্ণতা একটি কৌতুক। এটি একটি পয়সা কামানোর ব্যবসা।”
প্রায় ৫৫ লক্ষ বর্গকিলোমিটার জুড়ে গড়ে উঠেছে পৃথিবীর ফুসফুস খ্যাত দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন নদের পাশের এই রেইনফরেস্ট মহাবন আমাজন। এই বনে ৩০০শত এর বেশি উপজাতি বাস করে। তারা বেশির ভাগ ব্রাজিলীয়।
এছাড়া তারা পর্তুগীজ, স্প্যানিশ ইত্যাদি ভাষায় কথা বলে।এছাড়া তাদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি রয়েছে। এদের মধ্যে কিছু আছে যাযাবর। এদের বহিঃবিশ্বের সাথে তেমন যোগাযোগ নেই বললেই চলে।পৃথিবীর ২০ শতাংশ অক্সিজেন সরবরাহকারী এই জঙ্গলে রয়েছে বিভিন্ন প্রকার খনিজ সম্পদ।
মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার উপগ্রহ চিত্রেও ধরা পড়েছে আমাজনে ঘটতে থাকা ৯,৫০৭টি নতুন দাবানলের চিত্র। প্রায় ১,৭০০ কিলোমিটার দূরত্ব পর্যন্ত আগুনের লেলিহান শিখা ছড়িয়ে পড়েছে। ব্রাজিলের রোরাইমা প্রদেশ থেকে পেরুর রাজধানী লিমার আকাশেও হানা দিয়েছে বিষাক্ত ধোঁয়া।
ব্রাজিলের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইনপে- এর সমীক্ষা বলছে, গত বছরের এই সময়ের তুলনায় এই বছর আগুনের পরিমাণ ৮৩ শতাংশ বেশি এবং ২০১৩ সালের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ।
পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি জীব বৈচিত্র্যে ভরপুর এই অরণ্যে ২৫ লক্ষের বেশি পতঙ্গের প্রজাতি, ৪০ হাজারের বেশি গাছের প্রজাতি, দুই হাজার পাখি ও স্তন্যপায়ী প্রাণীর প্রজাতি এবং ২,২০০ প্রজাতির মাছের বাস।
আগুনে পুড়ে গেছে তাদের কিয়দাংশ। পৃথিবীর ফুসফুস খ্যাত এই অরণ্যের ৬০% ব্রাজিলে,১৩% রয়েছে পেরুতে এবং বাকি অংশ রয়েছে কলম্বিয়া, ভেনেজুয়েলা, ইকুয়েডর, বলিভিয়া, গায়ানা, সুরিনাম এবং ফরাসি গায়ানা।
পৃথিবী জুড়ে যে রেইনফরেস্ট তার প্রায় অর্ধেকটাই এই আমাজন বনাঞ্চল। পৃথিবীর বৈশ্বিক উষ্ণতা সঠিক রাখতে, জীববৈচিত্র্য রক্ষা করতে এবং মানবসভ্যতা টিকিয়ে রাখতে আমাজন বনাঞ্চল রক্ষার বিকল্প নেই।
লেখক:
মো. ওসমান গনি শুভ
শিক্ষার্থী, পালি এন্ড বুদ্ধিস্ট স্টাডিজ বিভাগ,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
(কলম থেকে কলাম ক্যাটাগরিতে প্রকাশিত মতামতধর্মী লেখার দায় লেখকের নিজস্ব)
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)
একই রকম সংবাদ সমূহ
‘ভূয়া’ সংবাদিকদের দৌরাত্মে সাধারণ মানুষ ভোগান্তিতে
সংবাদপত্রকে বলা হয় সমাজের দর্পণ বা আয়না। এই আয়নায় সমাজেরবিস্তারিত পড়ুন
এবার অভিনয়ে পরিচালক শিমুল সরকার
নজরুল ইসলাম তোফা:: পরিচালক শিমুল সরকার। সময়ের তরুণ জনপ্রিয় একজনবিস্তারিত পড়ুন
আজব এক ব্যক্তি কাঁচা মাছ, মাংস ও লতাপাতা খেয়ে স্বাভাবিক চলে
নজরুল ইসলাম তোফা:: জীবনে চলার পথে বহু রকম মানুষের সাথেবিস্তারিত পড়ুন