এক রোহিঙ্গার চিঠি- ‘আমাদের নিধন করা হচ্ছে’
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের এক রোহিঙ্গা নিবাসী সেখানে তাদের মানবেতর জীবনধারার বর্ণনা দিয়েছেন আল জাজিরাকে। রোহিঙ্গারা নিত্যদিন কি পরিমাণ নির্যাতন, নিপীড়ন সহ্য করেন তা উঠে এসেছে তার মুখে। আল জাজিরাতে প্রকাশিত ভাগ্যবিড়ম্বিত ওই রোহিঙ্গার চিঠির অনুবাদ এখানে তুলে ধরা হলো:
‘সারা জীবন, পুরো ২৪টা বছর, রাখাইন নামের উন্মুক্ত এই কারাগারে বন্দি হিসেবে বসবাস করে আসছি। আমি জন্মেছি মিয়ানমারে। আমার পিতা-মাতা’র জন্মও এখানে। কিন্তু মায়ের গর্ভে আসার আগেই আমার নাগরিকত্ব ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। আমার চলাফেরার অধিকার, শিক্ষা আর স্বাস্থ্যসেবার অধিকার এমনকি চাকরির অধিকারও মারাত্মকভাবে সীমিত করে দেয়া হয়েছে শুধু আমার জাতিগত পরিচয়ের কারণে।
সরকারি চাকরিতে আমার নিষেধাজ্ঞা। উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের অধিকার প্রত্যাখ্যাত। রাজধানী ইয়াঙ্গুনে যেতেও নিষেধাজ্ঞা। এমনকি রাখাইন রাজ্য থেকে বের হতেও বাধা দেয়া হয়। সব থেকে জঘন্য ধরনের সব বৈষম্যের শিকার আমি। কারণ একটাই- আমি রোহিঙ্গা; একজন রোহিঙ্গা মুসলিম। বছরের পর বছর ধরে আমার জনগোষ্ঠী সব থেকে মৌলিক সব অধিকার থেকে বঞ্চিত। প্রতিদিন তাদের হত্যা করা হয়। যখন খুশি খোলামেলা গুলি করে মারা হয়।
জোরপূর্বক আর নিয়মতান্ত্রিকভাবে বাস্তুচ্যুত করা হয়। আমাদের চোখের সামনে আমাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয়। আমরা বর্বর এক রাষ্ট্রের ভুক্তভোগী। আমাদের পরিস্থিতি আসলে কেমন সেটা আপনাদের বোঝানোর জন্য আমি একটা উপমা টানবো: মনে করুন ক্ষুধার্ত, হিংস্র একটি বিড়ালের সঙ্গে খাঁচায় আটকে পড়েছে একটি ইঁদুর। রোহিঙ্গা হওয়ার অর্থ ঠিক তেমনটাই। আমাদের বেঁচে থাকার একমাত্র উপায় হলো পালানো। অথবা, এমনটা আশা বেঁধে রাখা যে, কেউ হয়তো আমাদের বের হতে সাহায্য করবে।
আমরা যারা এখানে রয়ে গেছি, তাদেরকে বৃহত্তর রাখাইন গোষ্ঠীর থেকে পৃথক করার নিয়মতান্ত্রিক চেষ্টা চলে। আমাদের মুখের ওপর বৌদ্ধরা আমাদের ‘কালার’ (মুসলিমদের তাচ্ছিল্য করে বলা গালি) বলে। আপনি শিশু হোন বা বৃদ্ধ কোনো মানুষ, গালাগালি-নিপীড়ন থেকে কেউ রেহাই পায় না। আমরা স্কুলে আর হাসপাতালে বৈষম্যের শিকার হই। আর যেকোনো মূল্যে আমাদের বর্জন করার জন্য বৌদ্ধদের একটি প্রচারণা রয়েছে।
তারা বলে, ‘শুধু বৌদ্ধদের থেকে পণ্য কেনো। তুমি যদি একজন বৌদ্ধকে এক পয়সা দাও, তাহলে তারা প্যাগোডা নির্মাণে সহায়তা করবে, কিন্তু তুমি যদি একটা পয়সাও একজন মুসলিমকে দাও, তারা মসজিদ নির্মাণ করবে।’ এই ধরনের কথাবার্তা নিত্যদিনের নিয়মে পরিণত হয়েছে। আর বৌদ্ধ কট্টরপন্থিদের আমাদের ওপর চড়াও হতে উৎসাহিত করেছে। শান্তিতে নোবেল জয়ী অং সান সুচি যখন ২০১৫ সালে পার্লামেন্টারি নির্বাচনে জয়ী হলেন এবং সামরিক বাহিনীর অর্ধশতকব্যাপী আধিপত্যের ইতি টানলেন, আমাদের বড় প্রত্যাশা ছিল পরিবর্তন আসবে।
আমরা আত্মবিশ্বাসী ছিলাম যে এই নারী, যিনি কিনা গণতন্ত্রের আলোকবর্তিকা হিসেবে প্রশংসিত, তিনি আমাদের ওপর নির্যাতন, নিপীড়নের ইতি টানবেন। দুঃখজনক হলেও, দ্রুতই এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, তিনি শুধু আমাদের কণ্ঠ হবেন না তাই নয়, তিনি আমাদের দুর্দশাও উপেক্ষা করবেন। তার নীরবতায় এটাই প্রতীয়মান হয়েছে যে, এই সহিংসতায় তিনিও জড়িত। শেষমেশ, তিনিও আমাদের আশা ভঙ্গ করেছেন; আমাদের শেষ আশাও নিরাশ করেছেন।
২০১২ সালে অন্যতম জঘন্য এক সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়েছে। আনুমানিক ১ লাখ ৪০ হাজার অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছে। ২০১৬ সালে যেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। নিজেদের পরিবারের সামনে মানুষজনকে গুলি করা, হত্যা করা আর জীবন্ত পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। গত অক্টোবরের এই সহিংসতার পর উত্থান হয়েছে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (এআরএসএ), কিছুসংখ্যক পুরুষদের নিয়ে ছোট্ট একটি গ্রুপ- যারা নিজেদের আত্মরক্ষা এবং পাল্টা লড়াই করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
লাঠি আর পাথর খণ্ড তাদের অস্ত্র। তারা জানে যে তারা অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত মিয়ানমার সামরিক বাহিনীকে প্রতিহত করতে পারবে না কিন্তু তারা তারপরও চেষ্টা করছে। এখন আমাদের মা, বোনরা প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় ধানক্ষেতে সন্তান প্রসব করতে বাধ্য হচ্ছে। আপনারা যেই সহিংসতাকে সমশক্তিসম্পন্ন দুই পক্ষের দ্বন্দ্ব বলছেন- সেটা আসলে তা নয়।
শিশুদেরকে পালানোর সময় গুলি করা হচ্ছে। নারীদের লাশ ভাসছে নদীতে। এটা সমতার লড়াই নয়। আমাদের নিধন করা হচ্ছে। আর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যদি বিশ্বের অন্যতম নিপীড়িত এই আমাদের পাশে না দাঁড়ায় তাহলে আমরা গণহত্যার শিকার হবো। আর আপনারা সবাই হবেন এর সাক্ষী।’
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)
একই রকম সংবাদ সমূহ
১৪ জুলাই: যবিপ্রবির ল্যাবে সাতক্ষীরা জেলার ৩০ জন করোনা পজিটিভ!
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (যবিপ্রবি) জিনোম সেন্টারে ১৪ জুলাই,২০২০বিস্তারিত পড়ুন
এনামুল-সম্রাটসহ ৪ জনের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ
ক্যাসিনো ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ততা ও অবৈধ অর্থ লেনদেনের অভিযোগে সংসদবিস্তারিত পড়ুন
‘ভূয়া’ সংবাদিকদের দৌরাত্মে সাধারণ মানুষ ভোগান্তিতে
সংবাদপত্রকে বলা হয় সমাজের দর্পণ বা আয়না। এই আয়নায় সমাজেরবিস্তারিত পড়ুন