আমেরিকায় বাঙালি কমিউনিটিতে পরকীয়ার আগ্রাসন
বয়সের ব্যবধান, শিক্ষাগত বৈষম্য, কালচারাল বিরোধ এবং পেশা নিয়ে মিথ্যাচারের জের হিসেবে সংসার ভেঙে যাচ্ছে। ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে পারিবারিক বিরোধ চরমে উঠছে। পারস্পরিক অবিশ্বাস তছনছ করে দিচ্ছে প্রবাস জীবনকে। স্বপ্নের আমেরিকা ভেঙে চুরমার হচ্ছে।
সংসার ভেঙে যাওয়া পরিবারের সন্তানরা ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। কেউ কেউ ঠাঁই নিয়েছে সরকারি আশ্রয় কেন্দ্রে। আবার কেউ আত্মীয়-স্বজনের কাছে। নিউইয়র্ক, নিউজার্সি, পেনসিলভেনিয়া, ওয়াশিংটন মেট্রো ফ্লোরিডা, ম্যাসাচুসেটস, জর্জিয়া, ক্যালিফোর্নিয়া, টেক্সাস, মিশিগানসহ বিভিন্ন স্থানে গত দুই বছরে শতাধিক পরিবার ভেঙে গেছে। সংশ্লিষ্ট অ্যাটর্নি, কমিউনিটিভিত্তিক সংগঠনের কাছ থেকে জানা যায় এসব তথ্য।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে বিয়ে করে নিয়ে যাওয়ার পরই ডিভোর্সের ঘটনা বেশি ঘটছে। গ্রীনকার্ড হাতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্ত্রী কেটে পড়ছেন। ঝগড়ার নাটক করে কেউ কেউ পুলিশ ডাকেন। আবার কেউ স্বামীর অজ্ঞাতে বাসা ছাড়ছেন। এসময় স্বর্ণালঙ্কার এবং নগদ অর্থ নিয়ে যাওয়ার ঘটনাও রয়েছে। কোনো কোনো পরিবারে পারস্পরিক অবিশ্বাসের কারণে ভাঙন ধরেছে। স্বামী-স্ত্রী উভয়েই কর্মজীবী এমন পরিবারে পরকীয়ার অভিযোগ উঠলেই তা মারদাঙ্গা রূপ নিচ্ছে।
পুলিশ, জেল, জরিমানার পর তা গড়াচ্ছে ডিভোর্সে। সংসার ভাঙার ঘটনা বেশি ঘটছে সাম্প্রতিক সময়ে। ২০/২২ বছর সংসার করার পরও পারস্পরিক অবিশ্বাসের বলি হচ্ছেন অনেকে। এ সময় তারা এতটাই বেপরোয়া যে, স্কুল-কলেজগামী সন্তানের কথাও ভাবতে চাচ্ছেন না। একই বয়সী সহকর্মীর সঙ্গে পরকীয়ার ঘটনা দিনদিনই বাড়ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। কোনো কোনো মসজিদের ইমামকেও এ নিয়ে দেন দরবার করতে হচ্ছে। অনেক আঞ্চলিক সংগঠনের কর্মকর্তারাও চেষ্টা করছেন এমন ঝামেলা মিটিয়ে ফেলতে। কিন্তু তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সফল হচ্ছে না।
ডিভোর্সের প্রবণতা বেড়েছে অনেকের গ্রিনকার্ডের প্রত্যাশায়। যাদের স্ট্যাটাস নেই, তারা তালাকের মতো পরিস্থিতির শিকার হলে দ্রুততম সময়ে গ্রিনকার্ড পাওয়া যায়। তবে, গত দুই বছরে পুলিশ ডাকাডাকির যতগুলো ঘটনা ঘটেছে, তার সিংহভাগই সিটিজেন পরিবার। অর্থাৎ বৈধতার প্লট হিসেবে তারা মারদাঙ্গায় লিপ্ত হননি। প্রেমিক/প্রেমিকার সঙ্গে স্থায়ীভাবে বসতি গড়তেই চরম পরিস্থিতিতে ধাবিত হয়েছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, তালাকের শিকার পরিবারে স্বামীর চেয়ে স্ত্রীর আয় বেশি, স্বামীর চেয়ে স্ত্রীর শিক্ষাগত যোগ্যতা বেশি, স্বামীর চেয়ে স্ত্রী বেশি আধুনিক ছিলেন। অর্থাৎ সব সময় স্বামীকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হতো। আর এ সুযোগে পরিচিতরা ওই স্ত্রীর সান্নিধ্য লাভে সক্ষম হন। শুরু হয় পরকীয়া। নগদ অর্থের ছড়াছড়ি করতেও কেউ কেউ পিছপা হয় না। পরিণতিতে যা হওয়ার তাই হচ্ছে।
নিউইয়র্ক অঞ্চলে কয়েক মাস আগে শতাধিক শিশুকে সরকারি হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। এদের মা-বাবা মারপিটে লিপ্ত হয়েছিলেন। সাংসারিক টানাপড়েনে নয়, পরকীয়া অথবা পারস্পরিক অবিশ্বাসে। এসব শিশুর ভবিষ্যৎ নিয়ে ওইসব মা-বাবার ন্যূনতম মাথাব্যথা নেই। এমন পরিবারের স্বামী-স্ত্রী উভয়েই অল্প শিক্ষিত।
স্বপ্ন দেখতে দেখতে আমেরিকায় আসার পর মোহভঙ্গ ঘটেছে। অর্থাৎ কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা পাচ্ছেন না। আত্মীয়-স্বজনকে উপঢৌকন পাঠাতে সক্ষম হচ্ছেন না। এখানেও বাড়ি-গাড়ির মালিক হওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এমনকি বাসায় কাজের লোক রাখাও যোগ্যতাও নেই। এমন বাস্তবতাকে অনেক অর্ধ-শিক্ষিত মহিলা মেনে নিতে চান না। অন্যের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েন।
অপরদিকে, অনেক পুরুষও কর্মস্থলে সহকর্মী অথবা চলতি পথে পরিচয় হওয়া সুন্দরী নারীর প্রতি আকৃষ্ট হন। স্ত্রীর অজ্ঞাতে ওই শ্রেণির নারীর সঙ্গে ক্রমান্বয়ে ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েন। হোটেল-মোটেলের খরচ পোষায় না বলে সুযোগ বুঝে ঘরেই বেপরোয়া আচরণে লিপ্ত হন। গোপন কথাটি রয় না গোপনে। শুরু হয় কুরুক্ষেত্র।
আইনজীবীরা জানান, মামুলি বিষয়ে অনেক বাঙালির ঘর ভেঙেছে। কোনো কোন শ্বশুর-শাশুড়িরও ইন্ধন থাকে সংসার ভাঙার ক্ষেত্রে। সন্তানের বেশি স্বাচ্ছন্দ্য দেখার লোভে ভয়ঙ্কর একটি পরিস্থিতির মধ্যে ঠেলে দিচ্ছেন অনেক মা-বাবা।
আইনজীবী এবং মানসিক চিকিৎসকরা বলেছেন, এমন অবস্থার অবসানে দরকার কাউন্সেলিং। তাহলে ডিভোর্সের প্রবণতা রোধ করা সম্ভব। পরস্পরের ওপর অবিশ্বাসের ভীত কখনোই মজবুত থাকে না। তাই, কাউন্সেলিং পেলে সেই অবস্থার অবসান ঘটতে পারে। সন্তানদের অসহায় করে ডিভোর্সের মতো চরম একটি পথে পা বাড়ানো উচিত নয় কোনো মা-বাবারই। এছাড়া, সন্তানের সামনে ঝগড়ায় লিপ্ত হওয়াও সমীচীন নয়। এর ফলে সন্তানের ব্রেনে আঘাত লাগে। ওরা সব সময় অস্থিরতায় ভোগে। ভালো মানুষ হিসেবে বেড়ে উঠতে পারে না।
মা-বাবার কারণে যেসব শিশুকে সরকারি হেফাজতে নেওয়া হচ্ছে-তারা বাঙালি কালচার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। জীবন বলতে কিছু থাকবে না। ওরা বেড়ে উঠবে পরিচয়হীন একজন আমেরিকান হিসেবে। তা কোনো মা-বাবারই কাম্য হওয়া উচিত নয়।
অভিজ্ঞজনরা পরামর্শ দিয়েছেন, দেশে বিয়ে করার আগে সবকিছু প্রকাশ করা উচিত। বিশেষ করে আমেরিকায় আপনি কী করেন ? কত উপার্জন? লেখাপড়া কতটা করেছেন? বাসা-গাড়ি আছে কিনা ইত্যাদি। যাকে বিয়ে করছেন তার বয়সের সঙ্গে আপনার বয়সের ব্যবধান কত-এটিও প্রকাশ করা উচিত।
ডিভোর্সের শিকার অধিকাংশ পুরুষেরই বয়স প্রায় দ্বিগুণ ছিল নবপরিণীতার তুলনায়। অনেক সময় শুধু অর্থ-বিত্তে নারীরা সন্তুষ্ট থাকেন না। জৈবিক ক্ষুধাও মেটাতে হয়। সেটি করতে সক্ষম না হলেই নারীরা পর পুরুষে আকৃষ্ট হয়ে পড়েন।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী আরও জানা গেছে, অনেক মেয়েই আমেরিকায় আসার অভিপ্রায়ে যে কোনো বয়সী পুরুষকে বিয়ে করতে চান। তাদের টার্গেট হচ্ছে আমেরিকায় এসে গ্রিনকার্ড লাভ করা। এরপরই তারা প্রেমিকের কাছে ছুটেন। এমন ঘটনাও ইদানীং বেড়েছে। এ নিয়ে ডিভোর্সের জন্য আদালতে যাওয়ার প্রয়োজন হয় না। কারণ, মহিলারা স্বেচ্ছায় চলে যাচ্ছেন। এসব বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে বাংলাদেশে।
ভয়ঙ্কর এ পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে নিউইয়র্কে বসবাসরত অ্যাডভোকেট শামীম আরা ডোরা বলেছেন, ডিভোর্সের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় আমেরিকান স্বপ্ন তছনছই শুধু হচ্ছে না, বাঙালির ভবিষ্যৎও বিপন্ন হতে বসেছে। এ ব্যাপারে এখনই সজাগ হওয়া জরুরি। বাঙালি সমাজ ব্যবস্থা নিয়ে ভিনদেশিদের মধ্যে যে উচ্চ ধারণা রয়েছে, তা অটুট রাখতে সবাইকেই সচেষ্ট থাকতে হবে।
নারী-পুরুষ সবাইকেই এ দায় নিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে। লোভ-লালসা নয়, ন্যায়নিষ্ঠভাবে কাজে অর্জিত অর্থই সুপথের দিশা দিতে পারে। আর আমেরিকা হচ্ছে ভাগ্য গড়ার অপূর্ব সুযোগের দেশ। তাই সবাই যদি নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করি তাহলে আমেরিকান স্বপ্ন পূরণ করা অসম্ভব হয় না। এমন দৃষ্টান্ত প্রচুর রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সেনসাস ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালে নিউইয়র্ক সিটিতে প্রতি হাজার দম্পতির মধ্যে গড়ে ১২.৯টি ভেঙে গেছে। নিউজার্সিতে এ হার ১২.৭।
বস্টন অধ্যুষিত ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যে ডিভোর্সের এ হার ১২.৩। হাওয়াইতে ১২.৬। সবচেয়ে বেশি হচ্ছে আরকানসাসে-২৩.৪ এবং আইডাহোতে ২১.৯। নেভাদায় ডিভোর্সের হার প্রতি হাজারে ২১.৩।
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)
একই রকম সংবাদ সমূহ
পাকিস্তানে শক্তিশালী ভূমিকম্পে ১৯ জনের মৃত্যু
পাকিস্তানের উত্তরাঞ্চলে শক্তিশালী ৫ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্পের আঘাতে ১৯বিস্তারিত পড়ুন
২৪ ঘণ্টার মধ্যে ধেয়ে আসছে ঘূর্ণিঝড় হিক্কা
ধেয়ে আসছে প্রবল ঘূর্ণিঝড় হিক্কা। এর ফলে ঝড়ের পাশাপাশি ভারীবিস্তারিত পড়ুন
টিকাদানের সাফল্যে ‘ভ্যাকসিন হিরো’ পেলেন প্রধানমন্ত্রী
টিকাদানের সাফল্যে ‘ভ্যাকসিন হিরো’ পেলেন প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশে টিকাদান কর্মসূচি একটিবিস্তারিত পড়ুন