কলম থেকে কলাম
দাও ফিরিয়ে সে অরণ্য লও এ নগর
নগর সভ্যতার এই যুগে দিন দিন বাড়ছে কর্মজীবী মানুষের সংখ্যা। গ্রাম ছেড়ে মানুষ পাড়ি দিচ্ছে নগরের পানে।মানুষ এবং সভ্যতার প্রয়োজনে,পৃথিবীর ভৌগোলিক পরিবর্তনের কারণে নতুন নতুন শহর গড়ে উঠছে। বনভূমি কেটেই এইসব নগর তৈরি করছে মানুষ। ফলে বায়ুমন্ডলে অক্সিজেনের পরিমাণ দিন দিন কমে যাচ্ছে। শহরের কলকারখানার কালো ধোঁয়ার কারণে বাড়ছে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ। মানুষ প্রতিনিয়ত বিভিন্ন রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে। নিশ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে কালো ধোঁয়া শরীরের ভিতরে যাওয়ার ফলে বাড়ছে শ্বাসকষ্টে ভোগা রোগীর সংখ্যা৷ শহরের হাসপাতালে ঠাঁই মিলছে না বিদ্যমান বহু সংখ্যক রোগীর। চিকিৎসার অভাবে মারা যাচ্ছে শত শত মানুষ। এভাবে অরণ্য ধ্বংস করে নগর তৈরি করে বোধ হয় মানুষ নিজের ধ্বংস নিজেই ডেকে নিয়ে আসছে।
বর্তমান বাংলাদেশে বসবাস করা মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মুসলিম রোহিঙ্গারা কক্সবাজারের উখিয়া অঞ্চলসহ বিভিন্ন অঞ্চলে বন ধ্বংসের মহা-উৎসবে মেতে উঠেছে। তারা বনভূমি ধ্বংস করে বাংলাদেশের মানবসভ্যতাকে ধ্বংসের মুখে ফেলে দিচ্ছে। এছাড়া বনবিভাগের চোখ ফাঁকি দিয়ে অনেক অসাধু ব্যক্তিবর্গ বন ধ্বংস করছে এবং গাছ বিক্রি করে মোটা অংকের টাকা নিয়ে আঙুল ফুলিয়ে কলাগাছ তৈরি করছে। এভাবে বনভূমি ধ্বংস হতে থাকলে একদিন মানুষ অক্সিজেন স্বল্পতায় ভুগে পরপারে পাড়ি জমাবে। বাংলাদেশের রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, কক্সবাজার অঞ্চলে কিছু অসাধু ব্যক্তির যোগসাজশে বনাঞ্চল ধ্বংস করা হচ্ছে। এছাড়া বাংলাদেশের দক্ষিণ অঞ্চলে অবস্থিত পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবনও রয়েছে হুমকির মুখে।সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, পটুয়াখালী এবং বরগুনা অঞ্চল জুড়ে রয়েছে এই সুন্দরবন। তবে সাতক্ষীরা অঞ্চলে সুন্দরবনের সবচেয়ে বেশি অংশ অবস্থিত।এখানেও বন বিভাগের চোখ ফাঁকি দিয়ে বনের ভিতরের সমস্ত গাছ কেটে নিয়ে যাচ্ছে বন সন্ত্রাসীরা। নৌকা, লঞ্চ, স্টিমার,স্পিডবোট, ট্রলার এসব জলযান দিয়ে গাছে গুঁড়ি নিয়ে দূর অঞ্চলে বিক্রি করা হচ্ছে। সুন্দরবনের সুন্দরী, গেওয়া, কেওড়া,অসুর,ধুন্দল এবং গোলপাতা ইত্যাদি বিভিন্ন বৃক্ষ বিভিন্ন শিল্পকারখানার কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এক সমীক্ষায় দেখা যায়,এভাবে গাছ নিধন করতে থাকলে আগামী ২০০ বছরের মধ্যে সুন্দরবন অস্তিত্ব সংকটে পড়বে। বায়ুমন্ডলে বায়ুর পরিমাণ দিন দিন উল্লেখযোগ্য হারে কমছে যার জন্য মনুষ্যজাতি বহুলাংশে দায়ী। কোথাও কোথাও বন ধ্বংস করে গৃহ নির্মাণ করা হচ্ছে, কৃষিজমি বৃদ্ধি করা হচ্ছে, গো-চারণ ভূমি তৈরি করা হচ্ছে যা একজন মানবিক মানুষ হিসেবে কারোও কাম্য নয়।
সাম্প্রতিক পৃথিবীর সবচেয়ে বড় রেইন ফরেস্ট আমাজন বনাঞ্চলে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। অগ্নিকান্ডের এই ঘটনাটি দাবানল কিংবা মানবসৃষ্ট আগুনও হতে পারে। মানুষের কাছে বিপন্ন আমাজন। আমাজন নদীর অববাহিকায় বিস্তৃত বন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এই বনের আয়তন ৫৫লক্ষ বর্গ কিলোমিটার। প্রায় সাড়ে ৫ কোটি বছর আগে আমাজন বনাঞ্চলের উদ্ভব। বর্তমানে ৯টি দেশের সীমানা জুড়ে রয়েছে এই আমাজন। দেশগুলো হলো ব্রাজিল, পেরু, ইকুয়েডর, কলাম্বিয়া, বলিভিয়া, গায়ানা, ভেনেজুয়েলা, সুরিনাম এবং ফরাসি গায়ানা। পৃথিবীর ২০% অক্সিজেন আসে এই আমাজন বনাঞ্চল থেকে যার ৬০% ব্রাজিলে এবং ১৩% অবস্থিত পেরুতে। সর্বমোট, দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের ৪০ভাগ অংশ জুড়ে বিস্তৃতভাবে ছড়িয়ে আছে এই রেইন ফরেস্ট। প্রায়১৬ হাজার প্রজাতির ৩৯ হাজার কোটি গাছ আছে আমাজনে।
আটলান্টিক মহাসাগরের ওপারে অবস্থিত সাহারা মরুভূমি থেকে আসা ধুলায় উর্বর আমাজন। প্রতিবছর এই ধুলা থেকে পাওয়া যায় ২ কোটি টনেরও বেশি ফসফরাস। যা শতকের পর শতক টিকিয়ে রেখেছে বনের মাটির উর্বরতা। গাছপালার পাশাপাশি নানা প্রাণের স্পন্দনে সমৃদ্ধ এই মহাবন আমাজন । পোকামাকড়ের ২৫ লাখ প্রজাতি এবং ২ হাজার প্রজাতির পাখি- স্তন্যপায়ী প্রাণী রয়েছে এখানে। সন্ধান মিলেছে ৩৭৮ প্রজাতির সরীসৃপ ও ২,২০০ প্রজাতির মাছের প্রজাতি। প্রতি বছর প্রায় ২২০ কোটি টন কার্বন শুষে নেয় বনের গাছপালা। বিভিন্ন জটিল রোগের ওষুধের উপাদানের যোগান দেয় আমাজন। তবে দীর্ঘদিনের বন উজাড়ের প্রক্রিয়ায় আমাজন জঙ্গল এখন বিপন্ন। ১৯৬০ সাল পর্যন্ত আমাজনে গাছ কাটায় ছিলো কঠোর বিধিনিষেধ। তবে ৬০ এর দশক থেকে শিথিল হতে থাকে সরকারের নজরদারি। বন উজাড় করে তৈরি হয় চাষের জমি,গবাদিপশুর খামার, ফসলের ক্ষেত এবং গো-চারণভূমি। সেই সঙ্গে আমাজন বনাঞ্চলে প্রচুর পরিমাণ খনিজসম্পদ উত্তোলন, রাস্তাঘাট নির্মাণ, ঘরবাড়ি নির্মাণ ও বনাঞ্চল ধ্বংসের জন্য মানুষ অনেকাংশেই দায়ী। ২০১৮ সাল পর্যন্ত বিলুপ্ত হয়ে গেছে প্রায় ১৭ ভাগ বনাঞ্চল। সেখানে প্রতি এক মিনিটে ৩টি বড় ফুটবল মাঠের সমান বন উজাড় হচ্ছে। এই অবস্থা চললে আগামী ১০০ বছরে পুরোপুরি ধ্বংস হবে আমাজন বনাঞ্চল। চাষ কিংবা খামারের জমি তৈরির সহজ উপায় বনে আগুন দেওয়া। বনে আগুনের ঘটনা নিয়মিত হলেও এই বছরের এর মাত্রা অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে ফেলেছে। বন উজাড়ের অভিযোগ খোদ ব্রাজিল সরকারের বিরুদ্ধে।দুধ ও দুগ্ধজাত দ্রব্য উৎপাদনে ব্রাজিল রয়েছে পৃথিবীর শীর্ষস্থানীয় দেশসমূহের মধ্যে প্রথম সারির দিকে। যেহেতু গরুর দুধ উৎপাদন তাদের অন্যতম লক্ষ্য সেহেতু তারা গরু পালনের দিকে গুরুত্ব দিচ্ছে৷ আর গরু পালনের জন্য প্রয়োজনে অনেক পরিমাণ কৃষিজমি এবং গো-চারণভূমি। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জাইর বলসোনারো বনের চেয়ে উন্নয়নের দিকে বেশি নজর দিচ্ছে। বনাঞ্চলে ক্ষতির জন্য শাস্তির মাত্রা কমানোর প্রতিশ্রুতি রয়েছে তার। তবে আমাজনে আগুনের জন্য এনজিও দের দায়ী করেছেন প্রেসিডেন্ট। আগুন নেভাতে প্রায় ৫০হাজার সেনা মোতায়েন করেছিল ব্রাজিলের সরকার। প্রচলিত পদ্ধতির পাশাপাশি উড়োজাহাজ থেকে ফেলা হচ্ছে পানি। বিশ্ব নেতাদের আগুন নেভানোর সহযোগিতার প্রস্তাব প্রত্যাখান করেছে দেশটি। নিজেদের শক্তিতেই আগুন নেভাতে চায় ব্রাজিলের সরকারপক্ষ যেটি একটি অশনিসংকেতের নির্দেশনা প্রদান করে।
আমাজনে পশুপাখির পাশাপাশি বাস করে বহু সংখ্যক উপজাতি। সেখানে প্রায় ৩০০ এর বেশি উপজাতি সম্প্রদায় বসবাস করে। আদিমকাল থেকে বনের সাথে সংখ্যতা তাদের। বনের পশুপাখি শিকার করে তারা তাদের খাদ্য চাহিদা মেটায়। উপজাতিরা অধিকাংশ ব্রাজিলীয়।এছাড়া তারা পর্তুগীজ, স্প্যানিশ ইত্যাদি ভাষায় কথা বলে। তাদের রয়েছে নিজস্ব ভাষা এবং সংস্কৃতি। এদের মধ্যে কিছু আছে যাযাবর। এদের বহির্বিশ্বের সাথে কোনো যোগাযোগ নেই । বনে আগুনের ফলে এসব উপজাতিরা খাদ্য সংকট এবং প্রয়োজনীয় অক্সিজেন সংকটে পড়ছে। জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত আমাজন বনাঞ্চলে শুষ্ক অবস্থা বিরাজমান । খরা ও প্রাকৃতিক দূর্যোগের কারণে এই সময়টাতে দাবানলের ঘটনা ঘটে থাকে প্রতি বছর। আমাজন বনাঞ্চল যদি ধ্বংস হয় তবে পৃথিবীর বৈশ্বিক উষ্ণতা চিরতরে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।মানবসভ্যতা পড়বে তীব্র সংকটে। মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার উপগ্রহ চিত্রেও ধরা পড়েছে আমাজন বনাঞ্চলে ঘটতে থাকা ৯,৫০৭টি নতুন দাবানলের চিত্র। প্রায় ১৭০০কিলোমিটার দূরত্ব পর্যন্ত আগুনের ভয়াবহ লেলিহান শিখা ছড়িয়ে পড়েছে। ব্রাজিলের রোরাইমা প্রদেশ থেকে পেরুর রাজধানী লিমা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে বিষাক্ত বায়ু। ব্রাজিলের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইনপে’র সমীক্ষা বলছে, গত বছরের এই সময়ের তুলনায় এই বছর আগুনের পরিমাণ ৮৩ শতাংশ বেশি এবং ২০১৩ সালের তুলনায় প্রায় দ্বিগুন। বনাঞ্চলে উজাড়ের যেসব ক্ষেত্রে যন্ত্র ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে সেসব ক্ষেত্রে মানুষ সরাসরি আগুন দিয়েছে। ব্রাজিল সরকার তার দেশের বিদ্যমান অর্থনৈতিক মন্দা অপসারণ করতে এবং তার দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আনায়নের জন্য যে কার্যাবলি সম্পাদন করছে তা পৃথিবীর সব দেশের জন্য হুমকি স্বরূপ।
বাংলাদেশের সুন্দরবনের পাশে বাগেরহাট জেলার রামপালে যে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র তৈরি করা হয়েছে তার ফলেও সুন্দরবন হুমকির মুখে পড়বে।বিদ্যুৎ উৎপাদনের কেন্দ্রের কালো ধোঁয়া, বর্জ্য সুন্দরবনের প্রাণীদের জীবন এবং গাছপালা বিপন্ন করবে। বায়ুমন্ডলে অক্সিজেনের পরিমাণ কমবে। প্রাণীরা পড়বে তাদের জীবন সংকটে। অরণ্যের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সে অঞ্চলের জনগোষ্ঠী। পরিশেষে বলা যায়, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করতে,মানুষের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে এবং অক্সিজেনের অভাব পূরণ করতে অরণ্য রক্ষার প্রয়োজন অনস্বীকার্য।
লেখক:
মো. ওসমান গনি শুভ
শিক্ষার্থী, পালি এ্যান্ড বুদ্ধিস্ট স্টাডিজ বিভাগ,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
[কলম থেকে কলাম ক্যাটাগরিতে প্রকাশিত মতামতধর্মী লেখার দায় একান্তই লেখকের]
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)
একই রকম সংবাদ সমূহ
‘ভূয়া’ সংবাদিকদের দৌরাত্মে সাধারণ মানুষ ভোগান্তিতে
সংবাদপত্রকে বলা হয় সমাজের দর্পণ বা আয়না। এই আয়নায় সমাজেরবিস্তারিত পড়ুন
এবার অভিনয়ে পরিচালক শিমুল সরকার
নজরুল ইসলাম তোফা:: পরিচালক শিমুল সরকার। সময়ের তরুণ জনপ্রিয় একজনবিস্তারিত পড়ুন
আজব এক ব্যক্তি কাঁচা মাছ, মাংস ও লতাপাতা খেয়ে স্বাভাবিক চলে
নজরুল ইসলাম তোফা:: জীবনে চলার পথে বহু রকম মানুষের সাথেবিস্তারিত পড়ুন