জন্মভূমি সাতক্ষীরায় আড্ডায় আলাপনে ভারতের অভিনেতা মনোজ মিত্র
নাড়ির টানে শেকড়ের সন্ধানে এসে প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিলেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত নাট্যজন মনোজ মিত্র। শৈশবের ধুলিধূসর স্মৃতি আর বন্ধু বাৎসল্যের নানা ঘটনা স্মরণে এনে নিজেকে কিছু সময়ের জন্য হলেও হারিয়ে ফেলেছিলেন তিনি।
অস্তায়মান সূর্যের কিনারে এসে নিজেকে নতুন করে চিনবার চেষ্টায় অশ্রু ঝরিয়ে তিনি বললেন যারা এদেশ থেকে চলে গেছেন তাদের এক ধরনের কষ্ট রয়েছে। আর যারা দেশান্তরী হননি তাদের কষ্টও কম নয়। শিশু জীবনের খোলাধুলা পড়ালেখা আর প্রবীণদের শাসনের কথা স্মরণে এনে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ছিলেন তিনি। প্রায় চুরাশির এই প্রাজ্ঞ নাট্যজন ষ্পষ্ট ভাষায় নির্ভুল উচ্চারণে আরও বললেন স্মৃতি রয়ে যায়, স্মৃতি মুছে যায়না। এক পরিমন্ডল থেকে বেরিয়ে আরেক পরিমন্ডলে যেয়ে গড়ে তুলতে হয় নতুন ভূবন।
আষাঢ়ের ঘন ঘন দেয়া গর্জন আর বর্ষণ হুংকারের নির্মল পরিবেশে সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবে এমনই এক আড্ডায় মেতে উঠেছিলেন তিনি। সাথে ছিলেন তার সহোদর সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার জয়ী কবি অমর মিত্র ও যাদবপুর বিশ^বিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের প্রধান সৌমিত্র বসু।
শুক্রবার সন্ধ্যায় প্রেসক্লাবের শহিদ আলাউদ্দিন মিলনায়তন দর্শক শ্রোতায় টইটম্বুর হয়ে পড়ে। নাট্যকার ও নাট্যাভিনেতা সাতক্ষীরার ‘ধুলোর’ (ধুলিহর) গ্রামের সন্তান মনোজ মিত্র এদিন নিজেকে কিছু সময়ের জন্য হলেও এই মাটি ও মানুষের সাথে একাকার হয়ে যান। তিনি বলেন জন্মভূমি নিয়ে অনেক আবেগ আছে। শেকড়ে এলে নতুন অনুভব। বারবার তার স্মৃতিচারণে উঠে আসে ধুলিহর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ালেখার কথা। সাতক্ষীরা পিএন উচ্চ বিদ্যালয়ে ৩/৪ মাস লেখাপড়ার কথা। খেলার মাঠ আর বাড়ির পুকুর ঘাটের কথা। বললেন সে সময় স্কুলে লেখাপড়ার সাথে সাথে লং জাম্প, হাই জাম্প প্রতিযোগিতা হতো। আমরা হয়তো কোনো স্বার্থ লাভের জন্য ১১/১২ বছর বয়সে দেশান্তরী হয়েছি। এখনও মনে হয় কি যেনো এক অপরাধ করেছি। তার জন্য জ¦ালা যন্ত্রণা তো ভোগ করতেই হয়েছে। এই শহরের প্রাণ সায়ের খাল ছিল বড় নদীর মতো। পিএন স্কুলের সামনে সড়ক ধারে ছিল সারিবদ্ধ বকুল গাছ। এখানে রোজ এক মৌলভী সাহেব আসতেন। তিনি কি যেনো কেনাবেচা করতেন। প্রতিদিন তাকে আসতে দেখতাম গরুর গাড়িতে। প্রাণ সায়ের খাল ধারে বাস করতেন কোর্টের মোক্তাররা। স্মৃতিকথা উচ্চারণ করতে গিয়ে তিনি বললেন, এখানে ছিলেন একজন মোয়াজ্জেম ডাক্তার। তিনি অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসা করতেন। এখন সে গ্রাম পাল্টে গেছে। কোন রাস্তা কোথায় ছিল, কোথায় আমার স্বজনের বসত ছিল সবই যেনো ওলটপালট হয়ে গেছে।
সান্ধ্যকালীন এই কৌলিন আড্ডায় শামিল হয়েছিলেন সাতক্ষীরা- ১ (তালা-কলারোয়া) আসনের সংসদ সদস্য এড. মুস্তফা লুৎফুল্লাহ। তিনি বলেন, মনোজ মিত্রের সাথে এই আড্ডা আলাপ শেষ নয়। আমরা আবারও বৃহৎ কলেবরে আড্ডা জমাবো তার সাথে। সেদিন জানবো তার অভিনয় সম্পর্কে, নাট্যজগত সম্পর্কে। জানবো এবং শিখবো নাট্য রচনা ও অভিনয়ের শত কৌশল। এজন্য আগামি শীত মওসুমে আরও একটি আড্ডা আলাপনের আমন্ত্রণ জানিয়ে তিনি বলেন মনোজ মিত্রর মতো অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতিকর্মী বিজ্ঞজন যদি বাংলাদেশের মাটিতে থাকতেন তাহলে এদেশে জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা মাথা উঁচু করতে পারতো না।
মনোজ মিত্রের স্মৃতিচারণে উঠে আসে বাংলাদেশের নাট্যকার সেলিম আল দ্বীন, মামুনুর রশীদ, সৈয়দ শামসুল হক, রামেন্দ্র মজুমদার, ফেরদৌসী মজুমদার এর কথা। বিশেষ করে সেলিম আল দীনের নাটককে তিনি অন্য মাত্রার বলে মনে করেন। ভারতীয় সিরিয়ালগুলিতে যে চর্চা হচ্ছে তা কতোটা গ্রহণযোগ্য এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এর প্রতিবাদ করতে হবে। যেটুকু সম্ভব তা আদায় করতে হবে। এ প্রসঙ্গে তিনি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা নিয়ে কলকাতা দূরদর্শনের প্রথম সিরিয়াল ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’ এর কথা তুলে ধরেন। কলকাতার প্রকৃতি ও পরিবেশ আপনার চাহিদা মেটাতে পারে কিনা এবং এ কারণেই কি আপনার লেখার মধ্যে বারবার বাংলাদেশ বিশেষ করে আপনার জন্মভিটার কথা উঠে আসে এমন প্রশ্নের জবাবে এই বিশিষ্টজন বলেন, মনের চাহিদা এবং আপন অনুভূতির প্রকাশতো এভাবেই হয়। কোনো গন্ডির মধ্যে তো সে থাকতে চায় না। প্রখ্যাত এই নাট্যকার এ প্রসঙ্গে তার নিজের নাট্যসৃষ্টি পরবাস, দর্পণে শরৎ শশী, বাঞ্ছারামের বাগান, মৃত্যুর চোখে জলসহ বিভিন্ন নাটকের কথা তুলে ধরেন বলে এসবের পটভূূমি তার জন্মভূমি সাতক্ষীরা।
স্মৃতিচারণকালে উঠে আসে তিনি ১৯৩৮ এর ২২ ডিসেম্বর ধুলিহর গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। ১৯৫০ এর দিকে তিনি দেশ ত্যাগ করেন তার পরিবারের সাথে। মনোজ মিত্র ১৯৫৫ তে অভিনয় শুরু করেন। ১৯৫৭ তে কলকাতায় মঞ্চ নাটকে অংশ নেন তিনি। ১৯৭৯ তে চলচ্চিত্রে পা রাখেন মনোজ মিত্র। তিনি ছিলেন রবীন্দ্র ভারতী বিশ^বিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের অধ্যক্ষ। এর আগে তিনি বিভিন্ন কলেজে দর্শন বিভাগেও শিক্ষকতা করেছেন। ১৯৭২ সালে তার নিজের নাটক ‘চাকভাঙ্গা মধু’ মঞ্চস্থ হয়। শতাধিক নাটকের লেখক মনোজ মিত্র তার শিল্পকর্মের জন্য বহুবার পুরস্কৃত হয়েছেন। তার ভাষায় ‘আমি অভিনেতা, আমি মানুষের মনের কথা বলতে ভয় পাই না।’
শিল্প সংস্কৃতি নাট্যকলার এই প্রবীণ ব্যক্তিত্বকে শ্রদ্ধা জানিয়ে তার শতায়ু কামনা করেন তার জন্মভূমি সাতক্ষীরার মানুষ।
শুক্রবারের এই আড্ডায় আরও শামিল হয়ে নিজেদের অভিব্যক্তি তুলে ধরেন সহোদর অমর মিত্র, অধ্যাপক সৌমিত্র বসু, সাতক্ষীরা প্রেসক্লাব সভাপতি অধ্যক্ষ আবু আহমেদ, অধ্যক্ষ আবদুল হামিদ, উপাধ্যক্ষ নিমাই মন্ডল, কল্যাণ ব্যানার্জি, ফাহিমুল হক কিসলু, কবি কিশোরী মোহন সরকার, অ্যাড. অরুণ ব্যানার্জি, পলাশ রহমান, আবু আফফান রোজ বাবু, কবি দিলরুবা রোজ, শুভ্র আহমেদ, কবি তৃপ্তি মোহন সরকার।
কবি স ম তুহিন ও সাংবাদিক হাফিজুর রহমান মাসুমের সঞ্চালনায় আড্ডায় আলাপনে যুক্ত হন কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, নাট্যকর্মী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিসহ সুশীল সমাজের মানুষ। তারা প্রাণভরে উপভোগ করেন মনোজ মিত্রর স্মৃতিচারণ।
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)
একই রকম সংবাদ সমূহ
এবার অভিনয়ে পরিচালক শিমুল সরকার
নজরুল ইসলাম তোফা:: পরিচালক শিমুল সরকার। সময়ের তরুণ জনপ্রিয় একজনবিস্তারিত পড়ুন
সালমানকে উৎসর্গ করে গাইলেন টুটুল
জনপ্রিয় রেডিও উপস্থাপক জহিরুল ইসলাম টুটুল শ্রোতা মহলে আরজে টুটুলবিস্তারিত পড়ুন
সন্তানকে নিয়ে নিউইয়র্কের পথে পথে তাহসান-মিথিলা
সন্তানকে নিয়ে নিউ ইয়র্কের পথে পথে তাহসান-মিথিলা। বিচ্ছেদ হলেও তাহসান-মিথিলাবিস্তারিত পড়ুন