সংবাদ, সাংবাদিকতা ও সংবাদপত্র
প্রফেসর মোঃ আবু নসর
মার্কিন কথা সাহিত্যিক মার্ক টোয়েন বলেছিলেন, প্রতিদিন দুটো করে সূর্য ওঠে। একটি প্রভাত সূর্য এবং অপরটি সংবাদপত্র সূর্য। প্রভাত সূর্যের চিরন্তন আলোয় সমগ্র জগত উদ্ভাসিত হয়। তেমনি সংবাদপত্র সূর্য বা সাংবাদিকতার কল্যাণে আমরা সমগ্র পৃথিবীর দৈনন্দিন ঘটনাবলীকে জানতে পারি। সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার দায়িত্ব প্রভাত সূর্যের মতোই চির ভাস্বর। সংবাদপত্রই জনতার শক্তি। জাতীয় সংসদ যেমন গণতন্ত্রের একটি স্তম্ভ সংবাদপত্র ঠিক তেমনি একটি স্তম্ভ। পার্থক্য এই যে, জাতীয় সংসদ সরকার কর্তৃক পরিচালিত, নিয়ন্ত্রিত ও অর্থায়নকৃত আর সংবাদপত্র সম্পূর্ণরূপে বেসরকারি পর্যায়ের একটি উদ্যোগ। সংবাদপত্রকে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয়। এই স্তম্ভের দায়ভার প্রহণ করা সবার পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ অর্থবল থাকলেও নৈতিক মনোবল অনেকের থাকে না। সংবাদপত্রের ইতিবাচক ভূমিকা ছাড়া কোনো আন্দোলন বেগবান বা গতিশীল হয় না। সংবাদপত্রের ক্ষুরধার লেখনী, কলাম, প্রবন্ধ, নিবদ্ধ, প্রতিবেদন সংগ্রামী জনতাকে অধিকার সচেতন করে তোলে। তাই বাস্তবিকই সংবাদপত্রই জনতার শক্তি। জনগণের স্বার্থরক্ষার আন্দোলনে রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও সংবাদপত্রের সম্মিলিত ভূমিকা অনস্বীকার্য। বাংলাদেশের সংবাদপত্র সর্বদা গণমুখী ভূমিকা পালন করে। গণতন্ত্রের স্বপক্ষে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা অব্যাহত রাখে। বিশেষ করে স্বৈরাচার বিরোধী সংগ্রামে সংবাদপত্র তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় স্বনামখ্যাত ও প্রথিতযশা সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্টদের জোরালো লেখা বাধ্যবাধকতা ও সীমাবদ্ধতার মধ্যেও জনগণকে দেশপ্রেমে উজ্জীবিত রাখে। বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্যেও সংবাদপত্রগুলো গণমানুষ্যের কথা বলে। গণআন্দোলনে সংবাদপত্র ও সাংবাদিক সমাজে এক বিশেষ ও ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে থাকে যা পাঠকদের মধ্যেও নতুন প্রাণস্পন্দনের সৃষ্টি করে।
পত্রিকার গণমুখী, গণতন্ত্রমূখী ও ইতিবাচক ভূমিকা দেশের সংবাদপত্র শিল্পকে সমৃদ্ধ করেছে। বাংলাদেশে সাংবাদিকতায় ও সংবাদপত্রে গণমানুষের কণ্ঠস্বর জোরালোভাবে প্রতিধ্বনিত হয়। গণতন্ত্র, সংসদীয় গণতন্ত্র, সুশাসক, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার প্রশ্নে এ দেশের সংবাদপত্র সবসময় একটি বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে আসছে। এছাড়া সংবাদপত্র মানুষকে সারা বিশ্বের সঙ্গে পরিচয় লাভের সুযোগ দান করে থাকে। জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস ও দুর্নীতির বিরুদ্ধেও সংবাদপত্র কঠিন ও শক্ত অবস্থান নিয়ে থাকে। ফলে দুর্নীতি বিরোধী সামাজিক আন্দোলনকে জোরদার করার ক্ষেত্রে সংবাদপত্র অনন্যসাধারণ ভূমিকা পালন করে যা ভূয়সী প্রশংসনীয়। মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে বিশেষ করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সংবাদপত্র এক যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করে আসছে। উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি রচনায় সংবাদপত্র নির্ভিক ও সাহসিকতার সঙ্গে এক অবিস্মরণীয় ও চিরস্মরণীয় ভূমিকা পালন করেছিল। গণতন্ত্রকে মজবুত ও শক্ত ভিত্তি দেয়ার লক্ষ্যে এ দেশের সংবাদপত্র ও সাংবাদিক সমাজ এক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে চলেছে। বর্তমানে বাংলাদেশে স্বাধীন ও মুক্ত সাংবাদিকতার পাশাপাশি দলীয় সাংবাদিকতাও বিরাজমান। সাংবাদিকদের নিজের বক্তব্য ও মতামত স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে তুলে ধরে তা সংবাদপত্রে পরিবেশনের মাধ্যমে শক্ত অবস্থান নেয়া সাংবাদিকের ও স্বাধীন সংবাদপত্রের নীতি ও রীতি হওয়া উচিৎ। কারণ সংবাদপত্র কোনো দলীয় প্লাটফর্ম নয়। মালিক, সম্পাদক, লেখক ও পত্রিকার সব সাংবাদিকদের একটা নৈতিক মূল্যবোধ ও মানদণ্ড থাকতে হবে। বস্তুত সংবাদপত্র একটি আদর্শভিত্তিক ব্যবসা। অন্যায় অবিচারের কাছে মাথা নত না করে একমাত্র পাঠকদের কাছে প্রতিদিনের জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণের মধ্যে সম্মানিত ও সমাদৃত হয় স্বাধীন সংবাদপত্র। মালিকের অঙ্গীকার এবং সাংবাদিকদের দক্ষতার সমন্বয়েই স্বাধীন সংবাদপত্র নির্ধারিত ও বিবেচিত হয়। স্বাধীন সংবাদপত্রের কাছেই পাঠকদের প্রকৃত ও প্রধান প্রত্যাশা। দেশের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরে স্বাধীন সংবাদপত্র অনন্য ভূমিকা পালন করে থাকে। সংবাদপত্র সমাজের দর্পণ। সাংবাদিকরা জাতির বিবেকের ব্যারোমিটার। তথ্য প্রমাণ সাপেক্ষে সংবাদপত্রের সব প্রতিবেদন বস্তুনিষ্ঠ হতে হবে। আর একজন সাংবাদিক হচ্ছে ‘দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের মতো’। একজন সাংবাদিক সমাজের প্রতিচ্ছবি। সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের গণমানুষের স্বার্থে কাজ করতে হবে। সাংবাদিক হতে হলে প্রতিটি বিষয় বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা থাকতে হবে।
এ পর্যায়ে সংবাদ, সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার সার্থক ও সমন্বিত বাস্তবরূপ উল্লেখযোগ্য। সংবাদ হলো সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ ঘটনাবলীর একটি বিবরণী যা জনগণের স্বার্থেই প্রকাশযোগ্য। যে ঘটনা, ভাব বা বিষয় সংবাদের মাপকাঠিতে প্রণিধানযোগ্য, তাই সংবাদ। অন্য কথায়, সংবাদ হলো সাধারণ মানুষের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কোনো সময়োপযোগী প্রতিবেদন। সংবাদের বৈশিষ্ট্য হবে সত্যনিষ্ঠ বা সত্যনির্ভর, যথার্থ, সহজ-সরল, সংক্ষিপ্ত, সুষম, বস্তুনিষ্ঠ, আপেক্ষিক ও রূচিশীল। ইংরেজিতে জার্নালিজম শব্দ থেকে সাংবাদিকতা কথাটি এসেছে। এই জার্নালিজম হলো জার্নাল ও ইজম এ দুটো শব্দের সমন্বিত রূপ। জার্নাল অর্থাৎ কোনো কিছু প্রকাশ করা, অন্য অর্থে দিনপঞ্জি এবং ইজম অর্থাৎ অভ্যাস বা অনুশীলন বা চর্চা। সম্পূর্ণ অর্থে দিনপঞ্জির অনুশীলন। সাংবাদিকতার আদি রূপটি প্রবর্তিত হয়েছিল জুলিয়াস সিজারের আমলে অর্থাৎ খ্রিষ্টপূর্ব ৫০ সালে। বিশেষ করে ১৮১৮ সাল থেকে ১৮২১ সাল ছিল এ অঞ্চলের সাংবাদিকতার ইতিহাসের এক যুগান্তকারী অধ্যায়। বৃটিশপূর্ব ভারতের সংবাদপত্রের নজির বলতে মোঘলদের রাজকীয় ফরমানের সংকলক ওয়াকিয়া নবি (ডধয়ঁরধয ঘধারবং) ব্যতীত আর কোন আবিস্কার এখনও করতে পারেন নি পণ্ডিতকুল। ভারতীয় উপমহাদেশে সংবাদপত্র প্রকাশের সূচনা হয় পলাশী যুদ্ধের মাত্র ১১ বছর পর ১৭৬৮ সালে।
মধ্যযুগে ভারত বর্ষে হাতে লেখা সংবাদপত্র প্রচলিত ছিল। মার্গারিটা বার্নাসের ‘দ্য ইণ্ডিয়ান প্রেস’ গ্রন্থসূত্রে জানা যায়, বাদশাহ আওরঙ্গজেবের সময় সাধারণ সৈন্যদের মধ্যে সংবাদপত্র বিলি করা হতো। ১৮২৮ সালে কর্নেল জেমস টড কয়েক’শ হাতে লেখা সংবাদপত্র প্রস্তুত করে তা লণ্ডনের এশিয়াটিক সোসাইটিতে পাঠাতেন। ১৭৮০ সালে কলকাতা থেকে প্রবাসী ইংরেজ জেমস অগাস্টাস হিকির প্রকাশিত প্রথম মুদ্রিত সংবাদপত্রটি ‘হিকির গেজেট’ নামে পরিচিত ছিল। প্রকৃতপক্ষে পত্রিকাটির নাম ছিল ‘বেঙ্গল গেজেট’ বা ক্যালকাটা জেনারেল অ্যাডভাইজার। ১৭০২ সালের ১১ মার্চ এডওয়ার্ড ম্যালেটা কর্তৃক প্রকাশিত বৃটেনের পথম দৈনিক পত্রিকাটির নাম ছিল ‘ডেইলি কুর্যাম্ট। চীন দেশের অভিযাত শ্রেনীর মধ্যে সর্বপ্রথম সংবাদপত্রের প্রচলন হয় বলে জানা যায়। জনশ্রতি আছে ইউরোপের ভেনিস শহরে প্রথম সংবাদপত্র মুদ্রিত হয়েছিল। আমাদের দেশে ইংরেজ পাদ্রীরা খ্রিষ্টান ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে ১৮১৮ সালে পশ্চিমবঙ্গের শ্রীরামপুরে ‘সমাচার দর্পণ’ নামে প্রথম সংবাদপত্র বাংলা ভাষায় মুদ্রিত করে প্রকাশ করেন। পরে ‘দিকদর্শন’, রাজা রামমোহন রায়ের ‘সংবাদ কৌমুদী’, কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের ‘সংবাদ প্রভাকর’ প্রকাশিত হয়। ঊনিশ শতকের গোড়ার দিকে আমাদের দেশে সংবাদপত্রের ব্যপকতা লাভ করে।
প্রফেসর মোঃ আবু নসর
সাবেক অধ্যক্ষ, কলারোয়া সরকারি কলেজ, সাতক্ষীরা।
সাবেক কলেজ পরির্দক, যশোর শিক্ষা বোর্ড
সাবেক ডেপুটি রেজিষ্ট্রার, নর্দান ইউনিভর্সিটি বাংলাদেশ
০১৭১৭-০৮৪৭৯৩
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)
একই রকম সংবাদ সমূহ
‘ভূয়া’ সংবাদিকদের দৌরাত্মে সাধারণ মানুষ ভোগান্তিতে
সংবাদপত্রকে বলা হয় সমাজের দর্পণ বা আয়না। এই আয়নায় সমাজেরবিস্তারিত পড়ুন
এবার অভিনয়ে পরিচালক শিমুল সরকার
নজরুল ইসলাম তোফা:: পরিচালক শিমুল সরকার। সময়ের তরুণ জনপ্রিয় একজনবিস্তারিত পড়ুন
আজব এক ব্যক্তি কাঁচা মাছ, মাংস ও লতাপাতা খেয়ে স্বাভাবিক চলে
নজরুল ইসলাম তোফা:: জীবনে চলার পথে বহু রকম মানুষের সাথেবিস্তারিত পড়ুন