কেন্দ্র থেকে মাঠ পর্যায়ে বেতন-ভাতা
মুক্তিযুদ্ধে বিতর্কিত ভূমিকা: জামায়াতে আবারও ব্যর্থ সংস্কার চেষ্টা!
অর্ধযুগ পর জামায়াতে ইসলামীর অভ্যন্তরে ফের সংস্কারচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেল। ২০১০ সালের ২৬ নভেম্বর সাবেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কামারুজ্জামানের পর সংস্কার উদ্যোগ গ্রহণ করে নায়েবে আমির পদ থেকে অব্যাহতি পেলেন কেন্দ্রীয় প্রবীণ নেতা আতাউর রহমান।
পূর্বাপর জামায়াত-শিবিরের বাকি তিনটি সংস্কার প্রস্তাবের মতো এবারও কেন্দ্রে ছিল, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে দলটির বিতর্কিত ভূমিকা ও মানবতাবিরোধীদের দল থেকে বাদ দেওয়ার বিষয়টি। জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরা এবং ঢাকা ও রাজশাহী মহানগর শাখার একাধিক গুরুত্বপূর্ণ সদস্য একটি অনলাইন সংবাদ মাধ্যমকে এসব তথ্য জানান।
সূত্রের দাবি, জামায়াতের নেতাকর্মীদের কাছে ৫ ফেব্রুয়ারি তাকে পদ থেকে অব্যাহতির সিদ্ধান্ত প্রকাশ হয়। দলের গঠনতন্ত্রের সর্বশেষ সংশোধনী প্রকাশের মাত্র কিছুদিনের মধ্যেই কেন্দ্রীয় পদ থেকে বিচ্যূত করা হলো আতাউর রহমানকে। এর পেছনে আমির মকবুল আহমাদের বিষয়ে কিছু প্রশ্ন উত্থাপন এবং পরিবর্তিত কর্মনীতি প্রণয়নের বিষয়টিই কারণ। এর আগে ১৯৮২ সালে প্রথমবার ছাত্র শিবিরের সভাপতি তৎকালীন সভাপতি আহমদ আবদুল কাদের ও সেক্রেটারি ফরীদ আহমদ রেজা, ২০১০ সালের শুরুতে শিবিরের সেক্রেটারি জেনারেল শিশির মুহাম্মদ মনির ও একই বছরের শেষ দিকে তৎকালীন সহকারী সেক্রেটারি কামারুজ্জামান জামায়াতের একাত্তরের ভূমিকা সংস্কার প্রস্তাব এনেছিলেন। প্রথম ও দ্বিতীয় প্রস্তাবে যুক্ত দুজনকেই সংগঠন থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় এবং আমৃত্যু কারাদণ্ড থেকে মাবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে মারা গেছেন কামারুজ্জামান। আর চতুর্থ প্রচেষ্টার সামনে থাকা আতাউর রহমানকে বহিস্কার করা না হলেও কেন্দ্রীয় কমিটিতে থেকে অপসারণ করা হল।
সূত্রগুলো জানায়, আতাউর রহমান সম্প্রতি জামায়াতে একটি সংস্কার প্রস্তাব আনেন। ওই সংস্কারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিষয়টি ছিল, বর্তমান আমির মকবুল আহমাদকে নিয়ে। ইতোমধ্যে তিনি আমির হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পরই তার একাত্তরের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠে গণমাধ্যমে। এরপর আন্তর্জাতিক মাবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনাল খোঁজ-খবর নিতে শুরু করে। বিষয়গুলোকে তুলে ধরে আতাউর রহমান একাত্তর পরবর্তী প্রজন্মের হাতেই জামায়াতের নেতৃত্ব দেওয়ার কথা বলেন। মকবুল আহমাদকে সরিয়ে মুক্তিযুদ্ধত্তোর নেতাদের দায়িত্বে আনার পরামর্শ দিয়েছেন। আতাউর রহমানের সঙ্গে এই প্রস্তাবে জামায়াতের কয়েকজনের সরাসরি যোগাযোগ ছিল, কিন্তু দলের হাতে পৌঁছে দেওয়ার কাজটি করেন আতাউর রহমান। দলে সক্রিয় ও নিবেদিত হিসেবে পরিচিত হওয়ায় সংস্কারবাদীরা তাকেই বেছে নেন। এক্ষেত্রে তাকে আমির হিসেবে মূল্যায়ন করার আলোচনা বাকিদের ছিল। যদিও এই সংস্কারপন্থীদের মধ্যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সাবেক ছাত্রশিবিরের নেতৃত্বটিকেই মনে করা হচ্ছে। এই সাবেক শিবির সভাপতিদের মধ্যে বর্তমানে প্রায় সবাই জামায়াতের কেন্দ্রীয় ও মহানগরের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আছেন। এমনকী ঢাকা নগরীর বেশিরভাগ নেতাকর্মীরাই রাবি থেকে আসা নেতাদের প্রভাবে পরিচালিত।
সূত্রের দাবি, আতাউর রহমানের প্রস্তাবের একটি বড় দিক হচ্ছে, ২৪ ঘণ্টা রাজনীতি করার বিষয়টি। জামায়াতে একেবারে ওয়ার্ড পর্যায় থেকেই ২৪ ঘণ্টার রাজনীতি বিষয়টি স্বীকৃত। নির্ধারিত সংখ্যার নেতাকর্মীরা ২৪ ঘণ্টার (হোল টাইমার) রাজনীতিক হিসেবে দলে পরিচিতি পান এবং দলীয় বেতন-ভাতায় নিজেদের জীবনভার নির্বাহ করেন। তবে গঠনতন্ত্র সংশোধনকে সামনে রেখে বর্তমান সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমান চেয়েছিলেন, ২৪ ঘণ্টার রাজনীতির বিষয়টি দল থেকে উঠিয়ে দিতে। এতে ব্যয় ভার সাশ্রয় ও ফান্ডে চাপ কমানোর বিষয়টি তিনি যুক্তি হিসেবে তুলে ধরেন। যদিও আতাউর রহমান সংস্কার প্রস্তাবে ২৪ ঘণ্টার রাজনীতির পক্ষে বলা হয়েছে।
সূত্রের ভাষ্য, নানামুখি চাপের কারণে জামায়াতের আমির-সেক্রেটারি অংশটি চেয়েছেন অর্থনৈতিক ফান্ডের খরচ কমাতে। যদিও আতাউর রহমানসহ রাবি থেকে উঠে আসা নেতৃত্বটি দলের বেতন-ভাতার বিষয়টি বিবেচনায় রেখে ২৪ ঘণ্টার রাজনীতির পক্ষে অবস্থান নেয় বলে ঢাকা মহানগর জামায়াতের একাধিক দায়িত্বশীল জানান।
সূত্রের দাবি, কেন্দ্রীয় আমির ও সেক্রেটারির বাড়ি, গাড়ি, স্টাফ, পরিবার চালানোর ব্যয়ভার নির্বাহ করতে হয় সংগঠনকেই। এক্ষেত্রে সাধারণ নিয়ম প্রচলিত আছে জামায়াতে। ২৪ ঘণ্টা রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে প্রতিটি থানায় ৪ জন, ওয়ার্ড পর্যায়ে ২ জন দায়িত্বশীলকে দল থেকে বেতন-ভাতা দেওয়া হয়। এ কারণেই গত কয়েকবছরে দল করার জন্য কর্মীরা উৎসাহিত হয়েছে দ্বিগুণহারে।
এর আগে এর আগে শনিবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) দলটির জ্যেষ্ঠ নায়েবে আমীর অধ্যাপক মুজিবুর রহমান এক বিবৃতিতে দাবি করেন, আতাউর রহমানকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়নি। যদিও নায়েবে আমীরের পদ থেকে তাকে অব্যাহতি দেওয়ার বিষয়টি বিবৃতিতে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। কোথাও কোথাও বহিষ্কারের তথ্য প্রচার করা হলেও সেটিকে ‘মিথ্যা’ বলে দাবি করেন মুজিবুর রহমান।
জামায়াতের কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরার সদস্য মাওলানা হাবিবুর রহমান একে ‘ষড়যন্ত্র’ হিসেবে দেখছেন। তার দাবি, অতীতে জামায়াতের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র হয়েছে, ভবিষ্যতেও হতে পারে। মওলানা আতাউরকে বহিষ্কার করার কথা ভুল ও মিথ্যা। যদিও এ প্রতিবেদকের প্রশ্নে আতাউরের অব্যাহতির প্রসঙ্গে কোনও মন্তব্য করেননি তিনি
ঢাকা মহানগরের গুরুত্বপূর্ণ এক নেতার ভাষ্য, ‘আতাউর রহমানের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ বা ভুল-ত্রুটি নিয়ে জামায়াতে কেউই মুখ খুলবে না। দলে তার আত্মত্যাগ স্মরণযোগ্য। এক্ষেত্রে শুধু দলের নায়েবে আমীর পদ থেকে তাকে সরানো হয়েছে।’
ইতোমধ্যে জামায়াতের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের একজন শীর্ষনেতা তার অনুগতনেতাকর্মীরা বলেছেন, আতাউর রহমানের মর্যাদা রাখতেই বহিস্কার করেনি কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। এক্ষেত্রে দলের জন্য তার অবদানকে স্মরণ করে শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
জামায়াতের সংশোধিত গঠনতন্ত্রের ধারা ৬ ‘র জামায়াতে মতবিরোধের সীমা এর ৩ উপধারায় বলা আছে, কোনও সদস্য (রুকন) জামায়াতের গৃহীত কোনও সিদ্ধান্তের সহিত তাহার দ্বিমতের কথা সিদ্ধান্তগ্রহণকারী সংস্থার বাহিরে প্রকাশ করিলে, তিনি জামায়াতের এমন পদে নিযুক্ত থাকতে পারিবেন না, যাহার কর্তব্যই হইতেছে জামায়াতের ঘোষিত নীতি বাস্তবায়ন কিংবা উহার ব্যাখ্যাদান করা।
সূত্রের দাবি, সংস্কার প্রস্তাবে কোনও ব্যক্তির নাম না থাকায় শুধুমাত্র আতাউর রহমানকেই কেন্দ্র থেকে সরে পড়তে হল। তবে যেকোনও দলেই রাজনৈতিক সংস্কার চেয়ে বিজয়ী না হলে সেই দল থেকে সরে পড়াই স্বাভাবিক হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছে। এ কারণে আতাউর রহমানের প্রস্তাবও বেশিরভাগের কাছে গ্রহণ না হওয়ায় তাকেও ব্রাত্য হতে হল জামায়াতে।
সূত্র জানায়, অতীতেও এই উদাহরণ রচিত হয়েছে। প্রস্তাব দিয়ে সফল না হলে সংশ্লিষ্টদের দল বা সংগঠন থেকে সরে পড়তে হয়েছে, গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ববঞ্চিত হতে হয়েছে।
বিগত দিনের সংস্কার চেষ্টা
১৯৮২ প্রথমবার একাত্তরের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলে তৎকালীন ছাত্র শিবিরের সভাপতি আহমদ আবদুল কাদের ও সেক্রেটারি জেনারেল ফরীদ আহমদ রেজা। তাদের দুজনকেই সংগঠন থেকে বাদ দেওয়া হয়। আহমদ আবদুল কাদেরকে চট্টগ্রাম কলেজে প্রহারও করে শিবিরের নেতাকর্মীরা। বর্তমানে তিনি ২০ দলীয় জোটের শরিক খেলাফত মজলিসের মহাসচিব। আর ফরীদ আহমদ রেজা প্রবাস জীবন যাপন করছেন।
২০১০ সালের জানুয়ারি তৎকালীন বিদায়ী সভাপতি রেজাউল করিমের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাৎ, একাত্তরে জামায়াতে ভূমিকাকে কেন্দ্র করে উদ্ভব পরিস্থিতিতে ওই সময়ের সাধারণ সম্পাদক শিশির মুহাম্মদ মনির সম্ভাব্য সভাপতি হলেও তাকে বাদ দেওয়া হয়। একই সঙ্গে অপসারণ করা হয় জুবায়ের আহমেদ ভূঁইয়া, নজরুল ইসলাম, আনিসুর রহমান, জাকির হোসাইন, শাহরিয়ার আলম সিফাত, নাসির আহমেদ মোল্লা, ডা. শহিদুল্লাহ শরীফ, শামসুদ্দিন ও আসাদ উদ্দিনকে। পরে শিশিরকে শান্ত করতে লন্ডনে ব্যারিস্টারি পড়তে পাঠানো হয়। বর্তমানে শিশির জামায়াতের ল উইংয়ের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে কাজ করছেন।
২০১০ সালে দলের পরিবর্তন আনতে সংস্কার প্রস্তাব করেছিলেন তৎকালে কারাবন্দি কামারুজ্জামান। নিজের হাতে চিঠিতে তার প্রস্তাব ছিল, ‘আমাদের যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের মিথ্যা অভিযোগ আনা হচ্ছে, তারা জামায়াতের নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়াবো এবং সম্পূর্ণ নতুন লোকদের হাতে জামায়াতকে ছেড়ে দেবো। ’
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ৭ নম্বর সেল থেকে জামায়াতে ইসলামীর বর্তমান নেতৃত্বকে ৩৬ পৃষ্ঠার একটি চিঠি লিখেছিলেন তিনি। ‘পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে নতুন কর্মকৌশল গ্রহণ সময়ের দাবি শীর্ষক চিঠি প্রকাশের পর মাওলানা নিজামী ছদ্মনামে, তার স্ত্রী শামসুন্নাহার নিজামী দলসমর্থিত পত্রিকাগুলোয় পাল্টাপাল্টি প্রবন্ধ লেখে। যদিও জামায়াতে কামারুজ্জামানের প্রস্তাব গৃহিত হয়নি। বিষয়টি স্বীকার করে তার ছেলে হাসান ইকবালও বাংলা ট্রিবিউনকে বলেছিলেন, বাবার পরামর্শ মেনে নিলে জামায়াতের ইতিহাস অন্যরকম হতে পারত।
দলটির একটি সূত্রের ভাষ্য, আশির দশকে নায়েবে আমীর মাওলানা আবদুর রহিমকে মতবিরোধের কারণে দল থেকে অব্যাহতি দিয়েছিলেন গোলাম আযম। মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত মাওলানা আবুল কালাম আজাদ বাচ্চুকেও অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল বলে একটি সূত্রের দাবি। তবে এই দুটো ঘটনার পেছনেই একাত্তরের ভূমিকা ছিল না জামায়াতে প্রচার আছে।
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)
একই রকম সংবাদ সমূহ
ট্রাম্পের হয়ে প্রচারণা চালানো মোদি’র তা ভারতের পররাষ্ট্রনীতির পরিপন্থী
২০২০ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে সামনে রেখে বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ডবিস্তারিত পড়ুন
ছাত্রদলের কাউন্সিল: ৮ভোটে হেরে গেলেন কেশবপুরের সেই শ্রাবণ
জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কাউন্সিলে সভাপতি পদে মাত্র ৮ ভোটে হেরে গেছেনবিস্তারিত পড়ুন
ছাত্রদলের নতুন সভাপতি খোকন, সম্পাদক শ্যামল
কাউন্সিলরদের প্রত্যক্ষ ভোটে নতুন নেতৃত্ব পেল বিএনপির সহযোগী সংগঠন ছাত্রদল।বিস্তারিত পড়ুন