বিএনপি অফিস নিলামে উঠছে!
খেলাপি ঋণের দায়ে নিলামে উঠতে চলেছে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়। ঢাকার অর্থ ঋণ আদালত নিলামের উদ্যোগ প্রায় চূড়ান্ত করে ফেলেছে।
ব্যাংক সূত্র জানায়, ১৯৯৬ সালে ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে ওই আদালতে মামলাটি দায়ের করা হয়। এ সময়ের মধ্যে ঋণগ্রহীতা দুইবার উচ্চ আদালতে রিট করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে মামলার কার্যক্রম স্থগিত হয়ে যায়। সর্বশেষ স্থগিতাদেশ কিছুদিনের মধ্যে উঠে যাবে। তখন ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বিএনপি কার্যালয় নিলামে তুলে তাদের পাওনা আদায় করবে।
বিএনপি নেতারা অভিযোগ করেন, দলের স্থায়ী কমিটি থেকে বহিষ্কৃত নেতা চৌধুরী তানভীর আহমেদ সিদ্দিকীর প্রতারণার খেসারত গুনতে হচ্ছে তাঁদের। তিনি নিজের বাড়ির দলিলপত্র ব্যাংকে বন্ধক রেখে ১৯৮০ সালের দিকে আরেকজনের সঙ্গে যৌথভাবে এসওডি ঋণ নিয়ে সেটি আর পরিশোধ করেননি। পরে বিএনপির প্রভাব খাটিয়ে তিনি ব্যাংক থেকে গুলশানের বাড়ি ও কালিয়াকৈরের নিজ সম্পত্তির দলিলপত্র বের করে এনে বিএনপি কার্যালয়ের দলিল ইকুইটেবল মর্টগেজ হিসেবে জমা দেন। কিন্তু টাকা পরিশোধ না করায় সংশ্লিষ্ট ব্যাংক তানভীর আহমেদ সিদ্দিকীর গুলশানের বাড়িসহ বিএনপি অফিস নিলামে তুলে অর্থ আদায়ের জন্য অর্থ ঋণ আদালতে মামলা করে, যা বর্তমানে রায়ের জন্য প্রস্তুত রয়েছে।
ইস্টার্ন ব্যাংকের প্রধান শাখা থেকে জানানো হয়, প্রচলিত রীতি অনুযায়ী খেলাপি ঋণ উদ্ধারের জন্য অর্থ ঋণ আদালতে মামলা করে বন্ধক রাখা সম্পদ বিক্রির মাধ্যমে অর্থ আদায় করা হয়। সে নিয়মে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তানভীর আহমেদ সিদ্দিকীর গুলশানের বাসভবন এবং নয়াপল্টনের পাঁচতলা ভবনটি বিক্রি করে পাওনা আদায় করবে।
ব্যাংকের প্রধান গণসংযোগ কর্মকর্তা জিয়াউল করিম বলেন, ‘অন্যান্য খেলাপি ঋণের মতোই এ ঋণটি উদ্ধারের চেষ্টা চলছে। এর সঙ্গে কারা জড়িত, সেটা বিবেচ্য নয়। আইন সবার ক্ষেত্রে সমান। দীর্ঘদিন ধরে অনাদায়ী ঋণটি নিয়ে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছে। অর্থ ঋণ আদালতের মামলা সাধারণত দুই বছরের মধ্যে নিষ্পত্তি হয়। কিন্তু এ মামলাটির বয়স ২০ বছর পেরিয়ে গেছে। এসব বিষয় আমাদের প্যানেল আইনজীবীরা গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে কাজ করছেন। ’
চৌধুরী তানভীর আহমেদ সিদ্দিকী নানা কারণে বিতর্কিত। ২০০৯ সালের ৯ মার্চ এক সংবাদ সম্মেলনে তাঁর ছেলে ইরাদ আহমেদ সিদ্দিকী অভিযোগ করেন, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া তাঁর কাছে পাঁচ কোটি টাকা ঘুষ চেয়েছেন। এ টাকা দেননি বলেই তাঁকে ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। এ সংবাদ সম্মেলনে তানভীর আহমেদ সিদ্দিকীও উপস্থিত ছিলেন। এর জের হিসেবে ১৭ মার্চ তানভীরকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়।
ইরাদ আহমেদ ফের আলোচনায় আসেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে। গত বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর রাত ১০টার দিকে তিনি ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাসে লেখেন, ‘শেখ হাসিনাকে হত্যা ছাড়া বাংলাদেশের ক্ষমতার ভারসাম্যতা ও গণতন্ত্র ফেরানো সম্ভব নয়। ’ সেখানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটি ব্যঙ্গচিত্রও পোস্ট করেন ইরাদ। এর প্রতিক্রিয়ায় সারা দেশে বেশ কিছু মামলা হলে তিনি আত্মগোপনে চলে যান। বর্তমানে তিনি কোথায় আছেন সেটা স্পষ্ট নয়। তবে ফেসবুকে তিনি নিজেকে ছায়া মেয়র হিসেবে পরিচয় দিয়ে যাচ্ছেন।
ঢাকার চতুর্থ অর্থ ঋণ আদালতে করা মামলার সূত্রে জানা যায়, বিএনপি নেতা এবং সাবেক মন্ত্রী তানভীর আহমেদ সিদ্দিকী ও তাঁর বন্ধু এ এইচ খান ১৯৮০ সালের ২০ আগস্ট ব্যাংক অব ক্রেডিট অ্যান্ড কমার্স ইন্টারন্যাশনাল থেকে ৩৫ লাখ টাকা ঋণ নেন। এর মধ্যে ওই ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে গেলে তাঁরা ইস্টার্ন ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খোলেন। এএইচ খান হলেন বঙ্গবন্ধুর খুনি ডালিমের ভাইয়ের শ্বশুর। ঋণগ্রহীতা হিসেবে তানভীর গ্যারান্টার হন এবং তাঁর বাড়ির দলিল মর্গেজ দেওয়া হয়। প্রতি মাসে সোয়া তিন লাখ টাকা করে এক বছরের মধ্যে পুরো অর্থ পরিশোধ করার জন্য তাঁরা চুক্তিবদ্ধ হন। কিন্তু এর এক টাকাও ঋণগ্রহীতারা পরিশোধ করেননি। উল্টো উচ্চ আদালতে দুই বার রিট করে মামলার সব কার্যক্রম স্থগিত করান। সে পাওনা ১৯৯৬ সালে সুদে-আসলে প্রায় সাড়ে তিন কোটিতে দাঁড়ায়। এখন সেটা প্রায় ১৩ কোটি টাকায় পৌঁছেছে।
১৯৮১ সালের ২১ আগস্ট সম্পূর্ণ টাকা পরিশোধ করার কথা থাকলেও আসামিদ্বয় ব্যাংকে একবারের জন্যেও যোগাযোগ করেননি। ব্যাংক থেকে অসংখ্য চিঠি দেওয়া হলেও এর কোনোটির উত্তর তাঁরা দেননি। ১৯৮৮ সালের ৭ ডিসেম্বর এক নম্বর আসামি এএইচ খান ব্যাংক বরাবর একটি চিঠি লিখে তাঁর এসওডি ঋণের বিপরীতে প্রদত্ত গুলশানের চৌধুরী তানভীর আহমেদ সিদ্দিকীর বাড়ির পরিবর্তে ২৮/১ নম্বর নয়াপল্টনের পাঁচতলা বাড়িসহ ৬.১৮ শতাংশ জমি সিকিউরিটি হিসেবে জমা রাখার আবেদন করেন, যা ব্যাংক কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৮৯ সালের ১৬ আগস্ট ওই সম্পত্তি ব্যাংকের কাছে রেজিস্ট্রিকৃত দলিলমূলে বন্ধক রাখা হয়। এর মাধ্যমে ওই সম্পত্তি বিক্রি করার বিষয়ে ব্যাংক আইনি ক্ষমতা পায়।
অভিযোগ সম্পর্কে চৌধুরী তানভীর আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, ‘কখন কোন ব্যাংকে আমি গ্যারান্টার হয়েছি সেটা কি মনে আছে? বিএনপি অফিসের দলিল বন্ধক রেখে ব্যাংক থেকে কোনো ঋণ নেওয়া হয়েছিল কি না তাও আমার জানা নেই। তবে ইস্টার্ন ব্যাংকের সঙ্গে একটি মামলা ঢাকার অর্থঋণ আদালতে চলছে। নথিপত্র না দেখে বিস্তারিত বলতে পারব না। মামলাটি সঠিক নয় বিধায় উচ্চ আদালত দুই বার এর কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছেন।’
দেশে এত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা থাকতে আপনারা সাংবাদিকরা আমার পেছনে লেগেছেন কেন—এ কথা বলেই তিনি মোবাইল ফোন সংযোগ কেটে দেন।
ব্যাংকের নথি সূত্রে জানা যায়, তানভীর আহমেদ সিদ্দিকী ১৯৮৯ সালের ৩০ জুলাই নিজ হাতে একটি আবেদনপত্র লিখে ব্যক্তিগত সহকারী শাহাবুদ্দিনের মাধ্যমে ব্যাংকে সিকিউরিটি হিসেবে রক্ষিত গুলশানের বাড়ির দলিল নিয়ে আসেন। সে সঙ্গে অঙ্গীকার করেন, পরে দরকার হলে সে দলিল ব্যাংককে দেওয়া হবে। মামলার দুই নম্বর আসামি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী হওয়ায় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তাঁর ব্যক্তিগত সহকারীর হাতে দলিল দিয়ে দেয়। এর বদলে তিনি বিএনপি অফিসের দলিল ব্যাংকে বন্ধক রাখেন। কিন্তু পরে অসংখ্যবার তাগাদা দেওয়া সত্ত্বেও তিনি ওই দলিল আর ব্যাংককে ফেরত দেননি।
জানা যায়, তানভীর আহমেদ একসময় বিএনপির ট্রেজারার ছিলেন। সে সূত্রে দলের সব হিসাব-নিকাশ এবং পাঁচতলা অফিস ভবনের দলিলপত্র তাঁর কাছে ছিল। এ সুযোগে তিনি দলীয় কার্যালয়ের মূল দলিল ব্যাংকে বন্ধক রাখতে সক্ষম হন। দেশের একটি প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলের অফিস কেন বন্ধক রাখা হচ্ছে—এ প্রশ্ন তখন ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা করেছিলেন। তানভীর সিদ্দিকী এর জবাবে বলেছিলেন, আর্থিক সমস্যা সমাধানের জন্যই দলীয় অফিস বন্ধক রেখে ব্যাংক থেকে টাকা নেওয়া হচ্ছে। কিছুদিন পর টাকা ফেরত দিয়ে দলিলপত্র ব্যাংক থেকে ছাড়িয়ে নেওয়া হবে। কিন্তু তা তিনি করেননি।
বিএনপির একজন প্রভাবশালী নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘তানভীর আহমেদ সিদ্দিকী কথায় কথায় নিজেকে জমিদার হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকেন। অথচ তাঁর কার্যকলাপ অত্যন্ত নিচু শ্রেণির। তা না হলে দলীয় অফিসের দলিল বন্ধক রেখে ঋণ নিয়ে তা নিলামে তোলার ব্যবস্থা করতে পারতেন না। ’
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, ‘আমরা বিষয়টি জেনেছি। আমাদের দলীয় কার্যালয় নিলামে উঠছে—সে ধরনের কোনো চিঠিপত্র এখনো পাইনি। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কতটা এগিয়েছে তা আমাদের আইনজীবীরা খোঁজখবর নিয়ে জানানোর পর আমরা বিস্তারিত তথ্য জানাতে পারব।
তবে আমরা মনে করি, কেউ এ ধরনের পদক্ষেপ নিলে সেটা হবে ষড়যন্ত্রমূলক। এরই মধ্যে মিথ্যা মামলায় আমাদের চেয়ারপারসনের বাড়ি বেদখল করা হয়েছে। এবার হয়তো দলীয় কার্যালয় নিলামে তোলার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। রাজনৈতিকভাবে চাপে ফেলার জন্যই এসব করা হচ্ছে। ’
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)
একই রকম সংবাদ সমূহ
ট্রাম্পের হয়ে প্রচারণা চালানো মোদি’র তা ভারতের পররাষ্ট্রনীতির পরিপন্থী
২০২০ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে সামনে রেখে বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ডবিস্তারিত পড়ুন
ছাত্রদলের কাউন্সিল: ৮ভোটে হেরে গেলেন কেশবপুরের সেই শ্রাবণ
জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কাউন্সিলে সভাপতি পদে মাত্র ৮ ভোটে হেরে গেছেনবিস্তারিত পড়ুন
ছাত্রদলের নতুন সভাপতি খোকন, সম্পাদক শ্যামল
কাউন্সিলরদের প্রত্যক্ষ ভোটে নতুন নেতৃত্ব পেল বিএনপির সহযোগী সংগঠন ছাত্রদল।বিস্তারিত পড়ুন