মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিরতা সৃষ্টির দুই নায়ক
গত মাসের ৪ তারিখ এক ঘটনায় বিশ্বজুড়ে সামাজিক যোগাযোগ ও সংবাদ মাধ্যমে শিরোনাম হয়ে ওঠে সৌদি আরব। রাজপরিবারের প্রভাবশালী ১১ সদস্যসহ সে দেশের অর্ধশত অভিজাতকে গ্রেফতার করে রিয়াদের বিলাসবহুল রিত্য কার্লটন হোটেলে নেয়া হয়। এর আগে দুপুরে সৌদি রাজা সালমান তার পুত্র মোহাম্মদ বিন সালমানকে প্রধান করে একটি দুর্নীতি দমন কমিটি গঠনের ঘোষণা দেন। ধরপাকড় চালানো হয় জুনিয়র সালমানের নির্দেশেই। চাঞ্চল্যকর এ ঘটনার কারণ স্পষ্ট হয় ওইদিন সন্ধ্যায়। সালমানের পদক্ষেপকে সমর্থন জানিয়ে টুইট করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। সৌদি আরবের অভ্যন্তরীণ দমন-পীড়নে মার্কিন প্রেসিডেন্টের এমন অনধিকার সাফাইয়ের কারণ তার জামাতা জ্যারেড কুশনার। সৌদি অভিজাতদের নজিরবিহীন গ্রেফতারের ঠিক এক সপ্তাহ আগে গোপন সফরে সে দেশে যান জ্যারেড। সালমানের সঙ্গে পরপর কয়েক দিন রাত ৪টা পর্যন্ত আড্ডা হয় তার। দুজন এ সময় বিভিন্ন কৌশল বিনিময় ও গল্পগুজব করেন বলে ওয়াশিংটন পোস্টের ডেভিড ইগনেশিয়াসের প্রতিবেদনে জানা যায়। জ্যারেডের পরামর্শেই সালমান ওই ধরপাকড় চালান। আর সালমানের কাণ্ডের সমর্থনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরব হন যুক্তরাষ্ট্রের টুইটার-ইন-চিফ ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি লেখেন, ‘রাজা সালমান ও তার পুত্রের প্রতি আমার বিরাট আস্থা রয়েছে, তারা জানেন তারা কী করছেন!’ গ্রেফতারকৃতদের সমালোচনা করে তিনি আরেক পোস্টে লেখেন, ‘এসব লোক দীর্ঘদিন ধরে তাদের দেশকে শোষণ করছিল।’
২০১৪ সালে রাজা সালমান সিংহাসনে আরোহণের পর থেকে তার কনিষ্ঠ স্ত্রীর জ্যেষ্ঠ পুত্র মোহাম্মদ হয়ে উঠেছেন সৌদি আরবের সবচেয়ে ক্ষমতাধর লোক। তার এ ক্ষমতার প্রতাপ সৌদি আরবের সীমানা ছাড়িয়ে অন্যান্য দেশেও ছড়িয়ে পড়েছে। সৌদি প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে তিনি প্রায় দুই বছর ধরে ইয়েমেনে নির্বিচারে বোমা হামলা চালিয়ে আসছেন।
সিরিয়াতেও সৌদি আরবের পরোক্ষ সামরিক অংশগ্রহণের মাত্রা বাড়িয়েছেন তিনি। গত জুনে রাজা সালমান তাকে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী ঘোষণা করেছেন। এমন পরিস্থিতিতে জুনিয়র সালমানের নির্দেশে ব্যাপক ধরপাকড় স্বভাবতই সৌদি আরবকে ঘিরে ও সৌদি আরবের কারণে অস্থিরতার আশঙ্কা বাড়িয়ে তোলে। নানা উদ্বেগ-ঔত্সুক্য সৃষ্টি হয় পুরো মধ্যপ্রাচ্যে। ৪ নভেম্বর দুপুরেই বৈরুত থেকে সৌদি আরবে গিয়ে পদত্যাগের ঘোষণা দেন লেবাননের প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরি। পদত্যাগের জন্য তিনি ইরানকে দায়ী করেন। হারিরির পদক্ষেপে তাজ্জব হয় পুরো লেবানন। আবার ওইদিন রাতেই সালমান ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসকে ডেকে পাঠান। আব্বাস সৌদি পৌঁছেন পরদিন। সেখানে সালমান তাকে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা দায়েরের হুমকি প্রত্যাহার করতে চাপ দেন। না হলে ওয়াশিংটন ডিসিতে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের কোনো কূটনৈতিক মিশন থাকবে না বলেও হুমকি দেন।
জুনিয়র সালমানের এসব অর্বাচীন কাণ্ডকীর্তিতে সঙ্গী হিসেবে রয়েছেন জ্যারেড কুশনার। সৌদি যুবরাজকে জ্যারেড ট্রাম্পের অন্দরমহলেরও ঘনিষ্ঠ করে তুলেছেন। সালমানের প্রতি ট্রাম্পের ‘আস্থা’ সম্পর্কে ইগনেশিয়াস লিখেছেন, ‘ধনকুবের ও রাজনৈতিকভাবে ভিন্নমতাবলম্বী হওয়ায় ট্রাম্পের অন্দরমহলের লোকেরা সালমানকে আপন করে নিয়েছেন।’ ট্রাম্প পরিবারের সদস্যরা ধনকুবের। তারা নিজেদের রাজনৈতিকভাবে ভিন্নমতাবলম্বী মনে করে; রাজনৈতিকভাবে ভুঁইফোঁড়— সেটা তো জানা কথা। আরব লেখক মুস্তাফা বায়ুমির মতে, ফিলিস্তিনের স্বার্থ বিসর্জন দিতে রাজি হওয়ার কারণেও ট্রাম্প পরিবার সালমানকে পছন্দ করেছে। কথা সত্যি। সালমানের হুমকি অনুযায়ী ওয়াশিংটনে ফিলিস্তিনি মিশনের অনুমতিপত্র বাতিল করা হয়েছে। গত বুধবার ট্রাম্প জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে একতরফা স্বীকৃতিও দিয়েছেন। জ্যারেড-সালমান জোট এখন ফিলিস্তিন ও আরবের বিভিন্ন নেতাকে একটি ‘শান্তি চুক্তি’ গেলার জন্য গোপনে চাপ দিচ্ছে। ইসরায়েলি পার্লামেন্টের ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত সদস্য আহমাদ তাবি জানান, এ চুক্তিতে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র অথবা পূর্ব জেরুজালেমের বিষয়ে কোনো কথা নেই। ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তুদের প্রত্যাবর্তনের কথাও নেই। শুধু রয়েছে অন্তঃসারশূন্য ‘নৈতিক সার্বভৌমত্বের’ কথা। আরবের একটি সূত্র নিউইয়র্ক টাইমসকে জানিয়েছে, জ্যারেডের জন্য সালমানের উপহার হিসেবে এ চুক্তি-প্রস্তাব করা হয়েছে।
জ্যারেড-সালমানের দোস্তির পেছনে ইসরায়েলের প্রতি পক্ষপাতের পাশাপাশি রয়েছে ইরানের প্রতি বৈরিতা। এ জুটির রোষে পুড়ছে ইয়েমেনও। সৌদি নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটের অবরোধে ইয়েমেনে দুর্ভিক্ষ ও মহামারী নেমেছে। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অবরোধ শিথিল করতে বললেও সৌদি জোট তাতে পাত্তা দিচ্ছে না। কারণ জানিয়েছেন সাংবাদিক লরা রোজেন। সৌদি ও আমিরাতিরা মনে করছে, এ অবরোধে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ও তার জামাতার নীরব সম্মতি রয়েছে।
জ্যারেড-সালমান উন্মত্ত জুটি তাদের দেশেও সমস্যা সৃষ্টি করছে। সৌদি সরকারে উপর্যুপরি রদবদল, মন্ত্রীদের অপসারণ, একেকটি দপ্তরের মাথার ওপর নতুন নতুন বিভাগ সৃষ্টি হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে পররাষ্ট্র দপ্তরকে না জানিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের কর্মকর্তাদের সঙ্গে জ্যারেডের আলোচনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসনকে বিব্রত করছে। ব্লুমবার্গ নিউজ জানিয়েছে, টিলারসন বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন হয়েছেন কাতারে সামরিক অভিযানের বিষয়ে সালমানের সঙ্গে জ্যারেডের আলোচনায়। এমনিতেই দোহা-রিয়াদের কূটনৈতিক টানাপড়েনে শ্যাম রাখি না কুল রাখি পরিস্থিতি ওয়াশিংটনের। এ অবস্থায় কাতারে হামলার বিষয়ে হঠকারী সমর্থন তুরস্ক, রাশিয়াকে যুদ্ধে টেনে আনবে; জড়িয়ে যেতে পারে ইরানও। এমন জটিল ও ঘোলাটে পরিস্থিতিতে ইরানের বিরুদ্ধে সৌদি আরব ও ইসরায়েলের রোষ মিটলেও যুক্তরাষ্ট্র চোরাবালিতে আটকে পড়বে। জ্যারেডের খবরদারিতে বিপন্ন হয়ে পড়েছে মার্কিন কূটনীতি। কাতার, সৌদি আরব, জর্ডান, মরক্কো, মিসর— কোনো দেশেই এখন মার্কিন রাষ্ট্রদূত নেই। এ কারণে সৃষ্ট যোগাযোগহীনতায় পরিস্থিতি আরো সঙ্গিন হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক-কূটনৈতিক যোগাযোগ চ্যানেল বলতে রয়েছে জ্যারেড। প্রেসিডেন্টের জামাতার বালখিল্য অ্যাডভেঞ্চারিজমে সঙ্গত করতে মাথাগরম সালমান তো রয়েছেনই। অর্বাচীন এ জুটি যখন একের পর এক বড় সিদ্ধান্তে উপনীত হচ্ছেন, তখন তাদের চিন্তা-ভাবনায় ভুলের কথা কে বলবে? আলোচনা-শলাপরামর্শের উপযোগী পদাধিকারীর সংখ্যা তো তারা এরই মধ্যে কমিয়ে ফেলেছেন। (দ্য গার্ডিয়ান, আল জাজিরা ও অন্যান্য সূত্র)
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)
একই রকম সংবাদ সমূহ
পাকিস্তানে শক্তিশালী ভূমিকম্পে ১৯ জনের মৃত্যু
পাকিস্তানের উত্তরাঞ্চলে শক্তিশালী ৫ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্পের আঘাতে ১৯বিস্তারিত পড়ুন
২৪ ঘণ্টার মধ্যে ধেয়ে আসছে ঘূর্ণিঝড় হিক্কা
ধেয়ে আসছে প্রবল ঘূর্ণিঝড় হিক্কা। এর ফলে ঝড়ের পাশাপাশি ভারীবিস্তারিত পড়ুন
টিকাদানের সাফল্যে ‘ভ্যাকসিন হিরো’ পেলেন প্রধানমন্ত্রী
টিকাদানের সাফল্যে ‘ভ্যাকসিন হিরো’ পেলেন প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশে টিকাদান কর্মসূচি একটিবিস্তারিত পড়ুন