পেশা বদলেও ভাগ্য বদলায়নি তালার বাউল শিল্পী নির্ম্মল মন্ডলের
বড় শিল্পী হওয়ার বাসনায় নিজের ইচ্ছায় মাত্র ১২/১৩ বছর বয়সেই তালিম নিয়েছিলেন ওস্তাদ বাউল শিল্পী ফরিদপুরের খাতের আলী ফকিরের কাছে, এরপর গুরুদাস হাজরা। সবশেষে বিশে হাড়িকে গুরু মেনে বাউল শিল্পী হিসেবে যাত্রা শুরু তালা উপজেলার নির্ম্মল মন্ডলের। এখন বয়স ৭০ এর কোঠায়। তবে গান ছেড়ে দিয়েছেন আরো বছর সাতেক আগে। স্বপ্নের দোতারাটাও দান করেছেন ঘনিষ্ঠজন বন্ধুবর আরেক নির্ম্মলকে। তার আক্ষেপ,সারা দিন গান গেয়ে বেলা শেষে খালি হাতে বাড়ি ফেরা,তার পর বউ,ছেলে-মেয়েদের নিয়ে নিত্য দিনের উপোস থাকা। জীবনে আর পেরে উঠছিলনা। অগত্যা, বউ-সন্তানদের কথায় জীবিকা নির্বাহে পেশা বদল হয় নির্ম্মলের। ৩ মেয়ের দু’জনকেই পাত্রস্থ করেছেন। ২ ছেলের ১ জনের বিয়ে হয়েছে। তবে ছোটটাও দাদার সাথে ঘুরে বেড়ান পৈত্রিক পেশা শূকর পালনে। নির্ম্মলের এখন বয়স হয়েছে। শরীরেও বাসা বেঁধেছে নানা রোগ। দূরারোগ্য শ্বাস কষ্ঠ ও সাইটিকা বাত সারাক্ষণ তাড়া করে ফিরে তাকে।
এখন আর কেউ আমাদের গান শোনেনা
শেষ সময়ে তার আক্ষেপ, পূর্ব পুরুষের বসত-ভিটাটুকুও সরকারের ছিল। আজো তা নিজের হয়নি। ইতোমধ্যে প্রতিবেশীরা তার বন্দোবস্ত নিয়ে ফেলেছে। তবে এখনো তাড়িয়ে দেয়নি। ইচ্ছা,সন্তানদের জন্য মাথা গোঁজার ঠাঁই টুকুর হিল্লে করা। নিজেও জানেননা তার স্বপ্ন পূরণ হবে কিনা।
শুক্রবার শেষ বিকেলে কথা হচ্ছিল,সাতক্ষীরার তালা উপজেলার খলিলনগরের অজ পাড়ার মৃত বাদল মন্ডলের ছেলে বহুল পরিচিত বাউল শিল্পী নির্ম্মল মন্ডলের সাথে। পূর্ব পুরুষদের কেউ শিল্পী না থাকলেও ছোট বেলা থেকে অজানা খেয়ালে শিল্পী হওয়ার বাসনা জেঁকে বসে তার। বিভিন্ন দুয়ার ঘুরে চলে যান ফরিদপুরের গাড়াখোলার ওস্তাদ বাউল সম্রাট খাতের আলী ফকিরের কাছে। দীর্ঘ দিন তার কাছ থেকে তালিম নেওয়ার পরও শেখার ক্ষুধা নিবৃত হয়নি তাই,এবার আরেক ওস্তাদ অন্ধ বাউল গুরুদাশ হাজরার কাছে। (সে সময়ের মেট্রিক পাশ)। সর্বশেষ চলে আসেন নিজ উপজেলার বারুইহাটি গ্রামের বিশেহাড়ির কাছে। তার কাছ থেকে তালিম নিয়ে শুধু গানে মশগুল নির্ম্মল। গাইতে গাইতে বাড়ি-ঘর ছেড়ে এবার শুরু ছন্নছাড়া যাযাবর জীবনের। এভাবে গাইতে গাইতে মায়ের চাপে,ছেলেকে সংসারী করতে দেওয়া হয় বিয়ে। দাম্পত্য জীবনে জন্ম নেয়,৩ মেয়ে ক্রমান্বয়ে ময়না,আয়না আর বৈশাখী, ২ ছেলে সমীর ও শিমুল মন্ডল। ময়না-আয়নার বিয়ে হলেও বৈশাখীর বিয়ে দিতে পারেননি। বড় ছেলে সমীর ইতোমধ্যে বিয়ে করেছে,ছেলে(১)’র বাবা সে। তবে ছোট ছেলে শিমুলও দাদার সাথে মহাজনদের শূকর পালনে বছরের বেশিরভাগ সময় কাটায় বাইরে বাইরে।
বলছিলেন, গান ছেড়ে দেওয়ার গদ্যময় জীবন নিয়ে।
ক্ষুধার্ত ছেলে-মেয়েদের মুখে আহার তুলে দিতেই গান ছেড়েছেন
বছর সাতেক হল একবারে গান ছেড়ে দিয়েছেন। গাইতেও নাকি ইচ্ছে করেনা আর (আবেগী মন)। শৈশব থেকেই গানের সাথেই যার বেড়ে ওঠা,যৌবনের বহু বসন্তও পার করেছেন গানের পিছনে। সেই গানের মানুষটির কিনা এখন গাইতে ইচ্ছে করেনা আর গাইতে। রহস্য ভেদে বলেই ফেললেন,দরীদ্র-ভূমীহীন হলেও রাসভারী ’নির্ম্মল দা’ গান গেয়ে আর কি হবে? এখন আর কেউ মূল্যায়ন করেনা তাদের। আগের মত কেউ শোনেও না তাদের গান। এমন পরিস্থিতিতে দিনের পর দিন সারা দিন গান গেয়ে ভীক্ষাবৃত্তির পয়সায় ১ কেজি চালও জুটতনা। রাতে বাড়ি ফেরার পর বউ-ছেলে-মেয়েদের নির্ঘুম উপোসী দেহ গুলোকে দেখে দেখে বিরক্ত হয়ে উঠেছিলেন নির্ম্মল। রীতিমত নিজের প্রতিই(শিল্পী স্বত্ত্বার) ঘৃণা জন্ম নেয় অভিভাবক হিসেবে। কখনো কখনো ক্ষুধার্ত ছেলে-মেয়েদের নিয়েই বেরুতেন গানের ফেরী করতে। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত-ক্ষুধার্ত শিশুদের কাছে নির্লজ্জভাবে জিগ্যেস করতেন,ক্ষুধা পেয়েছে বাবা? প্রত্যুত্তরে ওদেরও সহাস্য জবাব ছিল,না বাবা!পেট ভরা। তবে আর পা এগুচ্ছেনা। বাবা হিসেবে তার অভয় বাণী ছিল,আর একটু হাট সামনের দোকান থেকেই খাবার কিনব। তবুও খাবার কেনা হত না। এমন নানা নির্ম্মম বাস্তবতায় একদিন দোতারা ফেলে চলে যান পরের কাজে শ্রম বিক্রিতে। একদিন নিজের স্বপ্নের দোতারাটাও দিয়ে দেন ঘণিষ্ঠ বন্ধু হানিরাবাদের মুনকিয়া এলাকার আরেক নির্ম্মলকে। এভাবেই শুরু হয় তার পেশা বদলের গল্প। তবে পেশা বদলেও ভাগ্য বদলায়নি নির্ম্মলের।
শেঁকড়ের ফেরীওয়ালার ঝরে পড়া
এখন আর কেউ খোঁজ নেয়না নির্ম্মলের। তবে নির্ম্মলের গান এখনো আনাচে-কানাচে ভেসে বেড়ায়। অনেকে এখনো গুণ গুণ করে গেয়ে ওঠে আমার মাটির গাছে লাউ ধরেছে,ঘুমাইয়া ছিলাম ছিলাম ভালো,বড় লোকে মোটর কেন চড়ে,মায়া নদী কেমনে যাবি বাইয়া,পোষা পাখি উড়ে যাবেসহ অসংখ্য গান। নির্ম্মল মূলত লালন ও বিজয় সরকারের গানই বেশী গাইতেন। নিজেও রচনা করেছেন অসংখ্য গান। সেসব গানের শুরও করেছেন তিনি নিজেই। তবে কয়েক বছর রেওয়াজ না থাকায় স্মৃতিভ্রম ঘটেছে নির্ম্মলের। কথামালাতেও ঘটেছে ছন্দপতন।
কথার ফাঁকে নতুন করে গাইতে ইচ্ছে করে কিনা জানতে চাইলে শক্ত জবাব,যে গানে ছেলে-পুলে না খেয়ে থাকে তাকে আর গলায় আনতে চাননা। তবে খানিকট নিস্তেজ থেকে নিচু স্বরে বলেই ফেলেন,গানই আমার প্রথম প্রেম,গানই আমার স্বপ্ন,গানই আমার বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা। তবে এখন অনেক দেরী হয়ে গেছে। ভালভাবে দম নিতে পারিনা। যদি কেউ দম নিতে (চিকিৎসা করাতে) সাহায্য করে।
এক কথায় সংসারের স্বচ্ছলতা আসলেই কেবল ফেরা সম্ভব গানে। শেঁকড়ের টানে ঐতিহ্য রক্ষায় অসহায়,ভূমিহীন,রোগগ্রস্থ শেঁকড়ের গানের ফেরীওয়ালা নির্ম্মলকে ফের গানের ভূবনে ফিরিয়ে আনতে পারে কেবল সেরকারি-বেসরকারি সহযোগিতা। এজন্য এলাকার সঙ্গীত প্রেমীরা সংশ্লিষ্ট সকলের সহযোগিতা কামনা করেছেন।
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)
একই রকম সংবাদ সমূহ
১৪ জুলাই: যবিপ্রবির ল্যাবে সাতক্ষীরা জেলার ৩০ জন করোনা পজিটিভ!
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (যবিপ্রবি) জিনোম সেন্টারে ১৪ জুলাই,২০২০বিস্তারিত পড়ুন
‘ভূয়া’ সংবাদিকদের দৌরাত্মে সাধারণ মানুষ ভোগান্তিতে
সংবাদপত্রকে বলা হয় সমাজের দর্পণ বা আয়না। এই আয়নায় সমাজেরবিস্তারিত পড়ুন
তালায় ইউএনও’র প্রেরণায় গার্লস হাইস্কুলে ডেইলি স্টার কর্নার চালু
তালা উপজেলা নির্বাহী অফিসার ইউএনও’র অনুপ্রেরণায় শহীদ আলী আহম্মেদ বালিকাবিস্তারিত পড়ুন