আরো খবর...
নড়াইলে প্রাসাদ বিলীন হলেও জমিদার কালীশঙ্কর রায়ের নাম আজও স্মরণীয়
নড়াইলের প্রভাবশালী হিন্দু জমিদার কালিশঙ্কর রায়’র বাড়ী!! কালের পরিবর্তনে জমিদারদের ঐশ্বর্য্য ও বিত্তশালী প্রতীক বিশাল জমিদারী ও সুন্দর প্রাসাদ অট্টালিকার স্মৃতি চিহ্ন বিলীন নড়াইলের জমিদারীর প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন কালিশঙ্কর রায় নামে জনৈক প্রভাবশালী হিন্দু। তার পিতার নাম ছিল রূপরাম রায়। রূপরাম দত্ত প্রসিদ্ধ গুয়াতলীর মিত্র বংশীয় কৃষ্ণরাম মিত্রের দ্বিতীয় কন্যাকে পরিনয় সূত্রে আবদ্ধ করেন। রূপরামদত্ত নন্দকিশোর, কালীশঙ্কর ও রামনিধি নামে তিন পুত্রের জনক। আমাদের নড়াইল জেলা প্রতিনিধি উজ্জ্বল রায়, জানান, রূপরাম অল্প বয়সে নাটোর রাজ সরকারে চাকুরি নেন। ধীরে ধীরে বিশ্বাসভাজন হয়ে তিনি সরকারের উকিল হিসেবে মুর্শিদাবাদ নবাব দরবারে কাজ করতেন। এই ভাবে তিনি যথেষ্ট অর্থ সম্পাদের মালিক হন। নাটোরের জমিদার রানী ভবানী একদিন রূপরাম রায়কে তাদের উকিল হিসেবে মুর্শিদাবাদের নবাব দরবারে পাঠান। নাটোরের রানী ভবানীর দয়ায় রূপরাম রায় নড়াইলের আলাদাতপুর তালুক কিনে নেন। এই তালুকের মধ্যে নড়াইল নামক স্থানে তিনি বসতবাড়ী নির্মাণ করেন। বসতবাড়ীর কিছুদূরে চিত্রা নদীর তীরে রূপরাম রায় একটি বাজার নির্মাণ করেছিলেন। রূপরামের নামানুসারে বাজারটি রূপগঞ্জ বাজার হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। আজও এই বাজারটি শহরের প্রধান বানিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে প্রসিদ্ধ। রূপরাম রায়ের তিন পুত্রের মধ্যে কালিশঙ্কর রায় অতি অল্প বয়সে পিতার সাথে নাটোর রাজ দরবারে প্রবেশ করেন। পিতার মত অল্প বয়সে নাটোরের রাজ সরকারের একজন কর্মচারী হিসেবে নিযুক্ত হন তিনি। এই কালিশঙ্কর ছিলেন নড়াইল জমিদারীর প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা। কালিশংকর রায় ছিলেন বলিষ্ঠ স্বাস্থের অধিকারী ও একজন সুচতুর ব্যক্তি। নিজে সাফল্য লাভের জন্য ন্যায়-অন্যায় বিচার বিবেচনা তার চরিত্রে ছিলনা। কৌষলে কার্য্যোদ্ধার করতে তিনি সুনিপুন ছিলেন। ডবংঃষধহফ এর রিপোর্টে তারই প্রতিধ্বনি শোনা যায়। কার্যোদ্ধারে তিনি ন্যায়ান্যায় বিচার করতেন না। ১৭৯৩ সালে ভারতবর্ষের গভর্ণর জেনারেল লর্ড কর্ণওয়ালিশ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তিত করলে সে সময় নাটোরের নড়াইলের প্রভাবশালী হিন্দু জমিদার বিশাল জমিদারীর বিপুল অংকের খাজনা বাকী পড়ে। খাজনার দায়ে ভাগে ভাগে নিলামে বিক্রি হতে থাকে জমিদারী। সেই সময় সুচতুর নড়াইলের প্রভাবশালী হিন্দু জমিদার কালিশংকর ও কতিপয় কর্মচারী নাটোরের জমিদারদের বিশ্বাসের অপব্যবহার করে স্বনামে ও বেনামে নাটোর রাজ্যের জমিদারী এলাকাভূক্ত পরগণা নিলামে খরিদ করতে থাকেন। পরগণাগুলো হচ্ছে তেলিহাটি, বিনোদনপুর, রূপপাত, তরফ কালিয়া, তরফ দরিয়াপুর ও অন্যান্য ছোট ছোট তোমিগাতি মহল। নড়াইল মৌজায় কালিশংকর রায় পিতার ছোট বসতবাড়ীতে বড় বড় দালান, কয়েকটি দীঘি, নাট্যমন্দির ও বিশাল রাজবাড়ী নির্মাণ করেন। কালিশংকর তার ক্ষমতা, প্রতিপত্তি ও মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য এক বিরাট লাঠিয়াল বাহিনী গঠন করেন। এই লাঠিয়াল বাহিনীতে যোগ দেয়া বেশিরভাগ লোক ছিল হিন্দু নিম্নবর্ণের নমশুদ্র সম্প্রদয়ের। কোথাও শক্তি প্রয়োগের প্রয়োজন হলে এই লাঠিয়াল বাহিনীকে কাজে ব্যবহার করা হতো। এই লাঠিয়াল বাহিনীর দ্বারা অনেক সময় ব্যবসায়ীদের নৌকার মালামাল লুট করে নেয়া হতো। যশোহরের প্রথম জজ ম্যাজিট্রেট হেঙ্কেল সাহেবের আমলে (১৭৮৪ খৃষ্টাব্দ) কালীশঙ্কর ও তাঁর জ্যেষ্ঠভ্রাতা নন্দকিশোরের নামে লুটতরাজ মামলা দায়ের করা হয়। সম্ভবতঃ কালীশঙ্কর ব্যবসায়ের দেনা পাওনার সূত্রে ক্ষিপ্ত হয়ে মাল ভর্তি একটি নৌকা লুট করে নেয়। হেঙ্কেল সাহেব তাকে ডাকাত নামে অবিহিত করে সরকারের নিকট রিপোর্ট পেশ করেন। কুতুবুল্লাহ সর্দারের অধীনে কিছু সিপাহীকে পাঠানো হলো কালীশঙ্করকে ধরে আনার জন্য। তাদের সাথে ১৫০০ লাঠিয়ালের এক খন্ড যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে ২ জন নিহত এবং কুতুবুল্লাহ সহ ১৫ জন আহত হয়। দ্বিতীয়বার সাহেব অতিরিক্ত সৈন্যদল পাঠালে নন্দকুমার ধরা পড়েন আর কালীশঙ্কর পালিয়ে যান। প্রথমে নাটোর ও পরে কোলকাতায় তিনি লুকায় থাকেন। অনেকদিন পর বহু কষ্টে তাকে কোলকাতা হতে গ্রেফতার করা হয় অতপরঃ মুড়লিতে নিয়ে আসা হয়। দারোগার বিচারে তিনি অব্যাহতি পান। নড়াইলের প্রভাবশালী হিন্দু জমিদার কালিশঙ্করের জমিদারী এলাকায় কোন গরু জবাইয়ের ঘটনা জানতে পারলে তিনি তার লাঠিয়াল বাহিনী দিয়ে সাথে সাথে তাকে ধরে নিয়ে যেতন এবং নিষ্ঠুর নির্যাতন চালাতেন। তার বাড়ীর সামনের রাস্তা দিয়ে কোন লোক ছাতা মাথায় এবং জুতা পায়ে হাটতে পারতো না। এই কালিশংকর প্রকৃত নড়াইল জমিদারীর প্রতিষ্ঠাতা পুরুষ। ১৮৭০ খৃষ্টাব্দে ৭০ বছর বয়সে কালিশঙ্কর ধর্ম যাত্রা ও মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হতে গয়া-কাশী গমণ করেন। কাশীতে দুবৃত্তদের উৎপাতে তীর্থযাত্রীগণ সবসময় সমস্যায় থাকতেন। সে দৃশ্য তিনি সহ্য করতে পারলেন না। তিনি নানারকম কুট কৌশলে অত্যাচারীদেরকে রাজদন্ডে দন্ডিত করে কাশীক্ষেত্রকে নিরূপদ্রব করেন। কাশীকে শান্তিময় অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য কাশীবাসী এখনও নড়াইলের প্রভাবশালী হিন্দু জমিদার কালীশঙ্কর রায়ের নাম স্মরণ করেন। কালীশঙ্কর ১৮৩৪ সালে ৮৫ বছর বয়সে পবিত্র কাশীধামে পরলোক গমন করেন। নড়াইলের প্রভাবশালী হিন্দু জমিদার কালিশঙ্করের দুই পুত্র রামনারায়ণ ও জয় নারায়ণ। গয়া-কাশীতে যাবার আগে দুই ছেলের নিকট তিনি তার সকল সম্পত্তি বুঝিয়ে দেন। কালীশঙ্কর কাশী যাওয়ার পর কয়েক বছরের ব্যবধানে দুই ছেলে মারা যায়। রামনারায়ণ ১৮১৭ সালে এবং জয়নারায়ণ ১৮২২ সালে মারা যান। কলিশঙ্করের বড় ছেলে রামনারায়ণের তিন পুত্র-রামরতন, হরনাথ ও রাধাচরণ। ছোট ছেলে জয়নারায়ণের দুই ছেলে ছিল দুর্গাদাস রায় ও গুরুদাস রায়। রামনারায়ণের তিন পুত্রের তিনজনই কীর্তি পুরুষ ছিলেন। দুর্গাদাস রায় ও গুরুদাস রায় নড়াইল থেকে দুই মাইল দক্ষিণে চিত্রা নদীর তীরে হাটবাড়ীয়া নামক গ্রামে বসতি স্থাপন করেন এবং জমিদারী সমান ভাগে পরিচালনা করতে থাকেন। রামনারায়ণের বংশধরগণ নড়াইলেই বসবাস করতে থাকেন। তাই নড়াইলের জমিদার ও জয়নারায়ণের বংশধরগণ ‘হাটবাড়ীয়ার জমিদার’ বলে পরিচিত হন। রামনারায়ণের বড় ছেলে রামরতনের নামে নড়াইল শহরের রূপগঞ্জ বাজারের ডাকঘরটি স্থাপিত হয়। সেই যুগ থেকে ‘রতনগঞ্জ’ ডাকঘর নামে পরিচিত। আজও এই ডাকঘরের নাম পরিবর্তন হয়নি। রামরতন রায়ের জমিদারী আমলে নলদী পরগণা ও খুলনা জেলার পরগণা দাঁতিয়া অন্তর্ভূক্ত হয়। এ সময় ইংরেজ নীলকর সাহেবরা যশোর ও কুষ্টিয়া অঞ্চলে নীলচাষের জন্য নীলকুঠি স্থাপন করে। জমিদার রামরতন রায় নীল চাষ লাভজনক বলে তিনিও এ ব্যবসা শুরু করেন। তিনি বহু নীল কুঠিও স্থাপন করেন এবং ইংরেজ নীলকর সাহেবদের নিকট থেকেও কিছু কুঠি ক্রয় করেন। রামরতন ছিল খুব সামপ্রদায়িক মনোভাবাপন্ন। যেসব কৃষক নীলচাষ করতে অনীহা প্রকাশ করতো তাদের উপর কঠোর নির্যাতন চালাতো তার লাঠিয়াল বাহিনী দিয়ে। হিন্দুধর্মের নমশুদ্র সম্প্রদায়ের চেয়ে মুসলিম কৃষকদের উপর তুলনামূলক বেশী অত্যাচার চালাতো। রামরতন রায় সাম্প্রদায়িক মনের ও অত্যাচারী থাকলেও শিক্ষা ক্ষেত্রে ছিলেন দানশীল। জমিদার রামরতন রায় তৎকালীন ভারত সম্রাজ্ঞী মহারানী ভিক্টোরিয়ার নামে একটি ইংরেজী হাইস্কুল স্থাপন করেন, যা বর্তমানে নড়াইল সরকারী ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট হাইস্কুল নামে পরিচিত হয়ে তার স্মৃতি বহন করছে। এই স্কুলকে কেন্দ্র করে ১৮৮৬ সালে একই নামে ইন্টারমিডিয়েট কলেজ স্থাপন করা হয়। কলেজটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে দ্বিতীয় প্রাচীন এবং খুলনা ও বরিশাল বিভাগের মধ্যে অন্যতম প্রাচীন কলেজ। রতন বাবু একটি দাতব্য চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। রতন বাবুর পুত্র কালীপ্রসন্ন অত্যন্ত নিষ্ঠাবান ও ধর্মপ্রাণ ছিলেন। রায় বাহাদুর হরনাথ বাবুর পৌত্র কিরণচন্দ্র গর্বণ সেন্ট কর্তৃক ‘রায় বাহাদুর’ উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন। তাঁর ভ্রাতাপুত্র ভবেন্দচন্দ্র উচ্চশিক্ষিত ও জনহিতৌষি ব্যক্তি ছিলেন। রাধাচরণ বাবুর পুত্র যোগেন্দ্রনাথ রায় শিক্ষিত ও বুদ্ধিমান জমিদার ছিলেন। তার জ্যেষ্ঠ পুত্র যতীন্দনাথ রায় ইংল্যান্ড হইতে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হয়ে বহু বছর যাবৎ ম্যাজিষ্ট্রেট ছিলেন। জমিদার রামরতন রায়ের মৃত্যুর পর তার মেঝে ভাই রায় বাহাদুর হরনাথ জমিদারীর কর্তৃত্ব গ্রহণ করেন। বর্তমান নড়াইল-যশোর পর্যন্ত যে পাকা রাস্তা দিয়ে আমরা যাতায়াত করি এই পাকা রাস্তা নির্মাণের জন্য প্রথমে তিনিই অনেক টাকা খরচ করেন। ১৭৮৬ সালে যশোর একটি জেলা রূপে পরিগণিত হয়। তৎকালীন যশোর জেলা বর্তমানের সমগ্র যশোর, খুলনা ও ভারতের বনগাঁ জেলা এবং কুষ্টিয়া ও ফরিদপুরের কিছু অংশ নিয়ে গঠিত ছিলো। ১৭৯৩ সালে নলদী পরগণাসহ ফরিদপুর জেলার পূর্বাঞ্চল যেমন- কাশিয়ানী মোকসেদপুর, কোটালিপাড়া, বোয়ালমারী, গোপালগঞ্জ সে সময় যশোর জেলার অন্তর্ভূক্ত ছিল। ১৮৪২ সালে খুলনাকে যশোরের একটি মহাকুমায় পরিণত করা হয়। তৎকালীন সময়ে অভয়নগর থানা এবং কালিয়া থানা খুলনা মহাকুমার অন্তর্ভূক্ত ছিল। ১৮৬১ সালে নীল বিদ্রোহের সময় নড়াইল মহকুমা স্থাপিত হয়। নড়াইলের জমিদারের কারণে মহাকুমার নাম হয় নড়াইল ও মহাকুমা সদর দপ্তর নড়াইলে স্থাপিত হয়। মহাকুমা সদর স্থাপনের জন্য স্থান নির্বাচন করা হয় প্রথমে গোপালগঞ্জে, পরে ভাটিয়াপাড়া, কালনা, লোহাগড়া, নলদী এবং সবশেষে বর্তমান জেলা শহরের মহিষখোলা মৌজায়। নড়াইলের প্রভাবশালী হিন্দু জমিদার বাড়ী ছিল একটি বিরাট এলাকা জুড়ে বহু সুরম্য অট্টালিকা, নাট্যমঞ্চ, পূজামন্ডপ, কাচারী ভবন, অতিথিশালা ও বিখ্যাত বাঈজিদের সাময়িক বাসস্থানরূপে ব্যবহৃত বিশ্রামাগার এবং বহু সংখ্যক পুকুর দীঘি। তৎকালীন পূর্ববঙ্গের মধ্যে এত বড় বাড়ী আর কোন জমিদারের ছিল না বলে তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়। ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতির ভিত্তিতে পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পর জমিদারগণ এ দেশ ছেড়ে ভারতের কোলকাতায় চলে যায়। ১৯৫০ এবং ১৯৫২ সালের দিকে কোলকাতা থেকে জমিদারদের কয়েকজন স্বল্প সময়ের জন্য আসলেও পরবর্তীতে আর আসেনি। পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে দীর্ঘদিন যাবৎ সংস্কারের অভাবে পুরাতন অট্টালিকাগুলি জরাজীর্ণ অবস্থায় আছে এবং বিভিন্ন মালামাল চুরি ও নষ্ট হতে থাকে। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার পর এখানে তৎকালীন আওয়ামীলীগ সরকার কর্তৃক গঠিত রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। এছাড়া সরকারী রাজস্ব বিভাগের কর্মচারীদের বাসাবাড়ী হিসেবে দীর্ঘকাল দালান বাড়ী ব্যবহৃত হতে থাকে। ১৯৮৫ সালের দিকে জমিদার বাড়ীর বিশাল দালান মাত্র পাঁচলক্ষ টাকায় সরকার নিলামে বিক্রি করে দেয়। জমিদার বাড়ীর সামনে একটি মন্দির ছাড়া আর কোন স্মৃতি নেই। এখানে গড়ে উঠেছে একটি সরকারী শিশুসদন। এছাড়া জমিদার বাড়ীর প্রায় ১০ একর জমির উপর স্থাপিত হয়েছে জেলা পুলিশ লাইন। জমিদার বাড়ীর পুকুর দীঘি আজও ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে রয়েছে। জমিদারদের বিভিন্ন ধরণের কাজের জন্য যেমন- বেহারা (পাল্কিবাহক), রাজমিস্ত্রি, লাঠিয়াল বা ঢালী, পূঁজাঅর্চনার জন্য পুরোহিত এবং নানা প্রকার সেবা কাজের জন্য দাস সমপ্রদায়, জমিদার বাড়ীর দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকের গ্রামে বসবাস করত। এই সকল সমপ্রদায়ের বংশধরেরা তাদের পেশা পরিবর্তন করেছে এবং অনেকে এখন লেখাপড়া করে অন্য পেশায় আত্মনিয়োগ করেছে। কিন্তু জমিদারদের অত্যাচারের কালের পরিবর্তনে জমিদারদের ঐশ্বর্য্য ও বিত্তশালী প্রতীক বিশাল জমিদারী ও সুন্দর প্রাসাদ অট্টালিকার স্মৃতি চিহ্ন টুকু বিলীন হয়ে গেছে। (সংগ্রীহিত)
কাঠের তৈরি খড়ম এখন শুধুই স্মৃতি…
আশির দশকেও নড়াইল জেলায় অনেকেই ব্যবহার করতেন খড়ম। বাংলাদেশে খড়মের ব্যবহার অনেক প্রাচীন। ভারত উপমহাদেশের বিশিষ্ট আউলিয়া হযরত শাহজালাল (র:) ১৪শ শতকে বাংলাদেশর সিলেটে বসতি স্থাপন করেছিলেন। তার ব্যবহৃত খরম এখনো তার সমাধিস্হল সংলগ্ন স্হাপনায় সংরক্ষিত আছে। সনাতন ধর্মে খড়মের ব্যবহার অনেক প্রাচীন তারা খড়মকে দেবতা ও শ্রদ্ধেয় সাধুসন্তদের পদচিহ্নের প্রতীকও মনে করেন অনেকে। সনাতন ধর্মের পাশাপাশি জৈনধর্মেও ভিক্ষাজীবি সন্ন্যাসী ও সাধুসন্তেরা খড়ম ব্যবহার করতেন। সনাতন ধর্মের মহাকাব্য রামায়ণে খড়মের একটি বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। এক সময় সমগ্র দেশের মানুষই নির্ভরশীল ছিলো ঐ কাষ্ঠ পাদুকা (খড়ম) এর উপর। নড়াইল জেলা প্রতিনিধি উজ্জ্বল রায় জানান, কিছুকাল আগেও খড়মের শব্দে গৃহস্থরা বুঝতে পারতেন তাদের বাড়িতে কেউ আসছেন। রুপসীগ্রাম-বাংলারপরিবারের সবাই ব্যবহার করতেন এই কাঠের তৈরি খরম। নড়াইলের কুড়িগ্রামের বাসিন্দা সনাতন ধর্মের তরু কুন্ডু (৭০) জানান, আগে বাড়ীতে কুটুম আসলে একজোড়া খরম আর এক ঘটি/পিতলের এক ঘোটি জল দিতাম হাত ও মুখ ধৌত করার জন্য।তিনি আরও জানান যে,আগে এই খড়ম পরে বিবাহ হত। এই খড়ম পায়ে দিয়েই নববধূ তার শশুর বাড়ীতে যেত। আধুনিকতার ছোঁয়ায় কাঠের তৈরি খড়ম এখন শুধুই স্মৃতি। কালের বিবর্তনে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী কাষ্ঠ পাদুকা খড়ম। এ শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্টদের এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না। জানা যায়, চামড়া, রেকসিন, প্লাস্টিক, কাপড় ইত্যাদি দিয়ে তৈরি জুতা এখন মানুষের পায়ে শোভা বর্ধন করে। বিগত কয়েক বছর ধরে বার্মিস জুতায় ছেঁয়ে গেছে নড়াইল শহর-এমনকি গ্রাম বাংলার মানুষের পায়ে পায়ে। কাঠমিস্ত্রি শ্রী নিরমল চন্দ্র রায় জানান যে, কাঠ দিয়ে তৈরি খড়ম পরিবেশবান্ধব। তারপরও মানুষ এটিকে পরিহার করেছে। অপরদিকে বার্মিস জুতা মানুষের মাথা গরম করা, পায়ের নিচের স্তর চামড়া মোটা করে বয়রা নামক রোগের সৃষ্টি করে। বয়রায় আক্রান্ত হয়ে অনেকেই চিকিৎসকদের কাছে যাচ্ছেন। তিনি আরও জানান, একখন্ড কাঠ পায়ের মাপে কেটে নিয়ে খড়ম তৈরি করা হয়। খড়মের সম্মুখভাগে একটি বর্তলাকার কাঠের গুটি বসিয়ে দেওয়া হয়, যা পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলি ও পাশের আঙ্গুলি দিয়ে আকড়ে ধরা হয়। আর এটি আবিষ্কার হয়েছিল মূলত মানুষের পা এর নিরাপওা বিধানের জন্য। কিন্তু এখন কেবল নিরাপওাই যোগায় না, বরং এটি সজ্জারও একটি অংশ। আকতার মোলা জানান, ৭০ এর দশক পর্যন্তও জনপ্রিয় ছিল খড়ম। তবে, সে সময় পশুর চামড়ায় তৈরি জুতাও কম-বেশি ছিল। পরে যানবাহনের চাকায় ব্যবহৃত টায়ার ও টিউব কেটে তৈরি হয় এক ধরনের জুতা। যার নামকরণ করা হয় টায়ার জুতা। কালের বিবর্তনে ঐ টায়ার জুতাটিও বিলুপ্ত হয়ে যায়। এর পর আসে সেন্ডেল। বর্তমানে বিভিন্ন মডেলের সেন্ডেলে বাজার সয়লাব। শিক্ষক সুলতান মাহামুদ, জানান একটি কাষ্ঠ পাদুকা খড়ম তৈরি করতে (মজুরি ও কাঠের দাম বাবদ) বর্তমান বাজারে খরচ পড়ে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা। পক্ষান্তরে বার্মিসের একটি পাদুকা পাওয়া যায় মাত্র ৮০ থেকে ১০০ টাকায়। দাম সাশ্রয়ী হওয়ায় সবাই বার্মিসের জুতাই ব্যবহার করেন। পৌর কমিসনার মাহাবুর আলম জানান, যুগের সাথে তাল মিলিয়ে আমাদেরও বার্মিস জুতা ব্যবহার করতে হচ্ছে। খড়ম পায়ে দিয়ে চলাফেরা করলে বেমানান মনে হয়, বিধায় ইচ্ছা থাকলেও আর খড়ম ব্যবহার করি না। তবে, এখনও খড়ম পায়ে দিয়ে চলাফেরা করেন এমন মানুষও কম-বেশি রয়েছে । মূলত তারাই ধরে রেখেছেন প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী খড়ম। ব্যবহারকারী কমে যাওয়ায় পরিবেশবান্ধব কাষ্ঠ পাদুকা বিলুপ্তপ্রায়। খড়ম শিল্পের সাথে জড়িত কারিগররাও কমে যাচ্ছেন।এভাবে কালের বির্বতনে হারিয়ে যাচ্ছে কুড়িগ্রাম জেলা থেকে ঐতিহ্যবাহী কাষ্ঠ পাদুকা (কাঠের তৈরি খড়ম)।
লাঙ্গল-জোয়াল-মই আধুনিকতার ছোঁয়ায় চিরতরে বিলীন
নড়াইলের গ্রামঞ্চলের কৃষিকাজে ফসলি জমিতে প্রাচীন উপকরণ লাঙ্গল জোয়াল মই চিরতরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে জেলার মানুষ কৃষি কাজের সাথে জড়িত। কৃষিকাজে কামারের তৈরি এক টুকরো লোহার ফাল আর কাঠমিস্ত্রির হাতে তৈরি কাঠের লাঙল, জোয়াল, খিল, শক্ত দড়ি আর নিজেদের বাঁশের তৈরি মই ব্যবহার করে জমি চাষাবাদ করতেন গ্রামঞ্চলের কৃষকরা। আমাদের নড়াইল জেলা প্রতিনিধি উজ্জ্বল রায় জানান, কৃষিকাজে ব্যবহৃত এসব স্বল্প মূল্যের কৃষি উপকরণ এবং গরু দিয়ে হালচাষ করে এ অঞ্চলের মানুষ যুগের পর যুগ ধরে ফসল ফলিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। এতে করে একদিকে যেমন পরিবেশ রক্ষা হয়, অন্যদিকে কৃষকের অর্থ ব্যয় কম হয়। ফসলের পাশের কিংবা ঘাসপূর্ণ জমিতে হাল চাষের সময় গরু যাতে কোনো খাদ্য খেতে না পারে, সেদিক লক্ষ্য রেখে পাট, বেত, বাঁশের কঞ্চি অথবা লতাজাতীয় এক ধরণের গাছ দিয়ে তৈরি গোমাই, তুরি (অনেকে ঠুসি নামে চেনেন) গরুর মুখে বেঁধে দেওয়া হয়। আর তাড়াতাড়ি হাল চালানোর জন্য ব্যবহার করেন বাঁশের বা শক্ত কোন লাঠি দিয়ে তৈরি পাচুনি (লাঠি)। এটি খুব বেশি দিনের কথা নয়, কয়েক বছর আগে এসব গরুর হালে লাঙ্গল-জোয়াল আর মই সাতক্ষীরা জেলার বিভিন্ন গ্রামের জমিতে হরহামেশাই দেখা যেত। চাষিদের অনেকে নিজের জমিতে হালচাষ করার পাশাপাশি অন্যের জমি চাষিয়ে পারিশ্রমিক হিসেবে কিছু অর্থও উপার্জন করতেন। তারা হাজারো কর্মব্যস্ততার মধ্যেও কখনো কখনো ফুরফুরে আনন্দে মনের সুখে ভাওয়াইয়া,পল্লিগীতি ও ভাটিয়ালী গান গেয়ে গেয়ে জমিতে চাষ দিতেন। এখন হাতে গোনা দু-একজন কৃষককে পাওয়া যায়। আর চাষ কাজের জন্য হালের গরু ছোট থাকা কালীন পোষ মানাতে বেশ কিছুদিন সময় লাগতো। ভোররাত থেকে শুরু করে প্রায় দুপুর পর্যন্ত জমিতে হালচাষ করতেন তারা। চাষিরা জমিতে হাল নিয়ে আসার আগে চিড়া-গুড় অথবা মুড়ি-মুড়কি দিয়ে হালকা জল খাবার খেয়ে নিতেন। তবে হুকা ও পাতা বা কাগজের তৈরি বিড়ি খাওয়া তাদের অভ্যাসে পরিণত ছিল বলে মনে করেন অনেকে। আবার একটানা হট হট, ডাই ডাই, বাঁই বাঁই, বস বস আর উঠ উঠ করে যখন ক্লান্তি আসত, তখন সূর্য প্রায় মাথার উপর খাড়া হয়ে উঠতো। এ সময় চাষিরা সকালের নাস্তার জন্য হালচাষে বিরতি রেখে জমির আইলের ওপর বসতেন। তাদের নাস্তার ধরনটাও ছিল ঐতিহ্যবাহী। এক থালা পান্তা ভাতের সঙ্গে কাঁচা অথবা শুকনো মরিচ, সরিষার খাঁটি তেল আর আলু ভর্তা। এসব তো গেল শুকনা মৌসুমে হালচাষের কথা। বর্ষাকালে কারো জমির চাষাবাদ পিছিয়ে গেলে সবার শেষে হাল চাষিরা নিজে থেকে হাল গরু নিয়ে এসে পিছিয়ে পড়া চাষিদের জমি চাষ দিতেন। হাল চাষিদের সঙ্গে আরো যোগ দিতেন ধানের রোপার চারা লাগার লোকজন। সকলের অংশ গ্রহণে উৎসবমুখর এই কাজটিকে বলা হতো-‘কৃষাণ’। কৃষ্যাণে অংশ নেওয়া কৃষাণদের জন্য জমিওয়ালা গেরস্থরা বড় বড় মোরগ, হাঁস কিংবা খাসি জবাই করে ভোজ করাতেন। কিন্তু আজকাল সময়ের আবর্তে সাতক্ষীরা জেলা থেকে এসব গরুর হাল, কৃষি উপকরণ কাঠের লাঙ্গল, জোয়াল, বাঁশের মই হারিয়ে যেতে বসেছে এবং হাল-কৃষাণ প্রায় বিলুপ্তির পথে। বিলুপ্তির কারণ, এ যুগে মানুষের অসীম চাহিদা আর অভাবময় জীবনে উন্নয়নের ছোঁয়া দিতে আবির্ভূত হয়েছে দামি দামি যান্ত্রিক হাল যেমন, কলের লাঙল, ট্রাক্টর। সঙ্গে এসেছে ফসলের বীজ বপন-রোপণ, ঝাড়াই-মাড়াই করার যন্ত্র। আর এসব যন্ত্র চালাতে মাত্র দু’একজন লোক প্রয়োজন। ফলে বিত্তবান কৃষকরা ওই যন্ত্র কিনে মজুরের ভূমিকায় কাজ করলেও গ্রামের অধিকাংশ মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত ও দিনমজুরের জীবন থেকে ঐ সব ঐতিহ্যময় স্মরণীয় দিন চিরতরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। আগামী প্রজন্ম হয়তো জানতেই পারবে না এভাবে অতীতে চাষ-কাজ করা হতো।
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)
একই রকম সংবাদ সমূহ
১৪ জুলাই: যবিপ্রবির ল্যাবে সাতক্ষীরা জেলার ৩০ জন করোনা পজিটিভ!
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (যবিপ্রবি) জিনোম সেন্টারে ১৪ জুলাই,২০২০বিস্তারিত পড়ুন
এনামুল-সম্রাটসহ ৪ জনের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ
ক্যাসিনো ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ততা ও অবৈধ অর্থ লেনদেনের অভিযোগে সংসদবিস্তারিত পড়ুন
‘ভূয়া’ সংবাদিকদের দৌরাত্মে সাধারণ মানুষ ভোগান্তিতে
সংবাদপত্রকে বলা হয় সমাজের দর্পণ বা আয়না। এই আয়নায় সমাজেরবিস্তারিত পড়ুন