ইসরায়েলের সঙ্গে কেন এই সৌদি দোস্তি?
অর্ণব সান্যাল : সৌদি আরব ও ইসরায়েল—এই দুই দেশের মধ্যে কৌশলগত জোট এখন বিশ্বরাজনীতির অন্যতম আলোচ্য বিষয়। ফিলিস্তিন ইস্যুকে সামনে রেখে এ দুই দেশের জোট গড়ার বিষয়টি এত দিন অসম্ভব বলে মনে হলেও সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায় এর বাস্তবতা দৃশ্যমান। কেন এই দুই বিপরীত আদর্শের দেশ হাত মেলাচ্ছে? কারণ কি শুধুই ইরান? নাকি অন্য কিছু?
বিবিসি বলছে, মধ্যপ্রাচ্যে দিন দিন শক্তিশালী হচ্ছে ইরান। এরই মধ্যে সিরিয়া ও লেবাননে শিয়াদের প্রভাব বেড়েছে। সিরিয়ায় প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের পক্ষে লড়ছে শিয়ারা। অন্যদিকে, লেবাননে হিজবুল্লাহ গোষ্ঠী শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। এই দুই ঘটনায় দুশ্চিন্তায় সৌদি আরব। সেই দুশ্চিন্তাই ইসরায়েলের কাছে পৌঁছে দিয়েছে সৌদি আরবকে। কারণ, মধ্যপ্রাচ্যে দাপট ফিরে পেতে হলে সৌদি আরবের এখন নতুন বন্ধু প্রয়োজন।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র পাশে থাকার পরও কেন ইসরায়েল? আল-জাজিরার বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, গত কয়েক বছরে মধ্যপ্রাচ্যে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা থেকে অনেকটাই সরে গেছে যুক্তরাষ্ট্র। সে জায়গায় ভাগ বসিয়েছে রাশিয়া। এ কাজে রুশদের প্রধান সহযোগীর ভূমিকায় অবতীর্ণ ইরান। এখন ইসরায়েলের সঙ্গে জোট বেঁধে আবার মধ্যপ্রাচ্যের মোড়ল হতে চাইছে সৌদি আরব।
গত সপ্তাহে যুক্তরাজ্যভিত্তিক সৌদি পত্রিকা এলেফকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ইসরায়েলের সেনাপ্রধান জেনারেল গাদি আইজেনকোট বলেন, ইরানকে ঠেকাতে সৌদি আরবের সঙ্গে গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদানে প্রস্তুত ইসরায়েল। এর কিছুদিন পরই ইসরায়েলের একজন সাবেক জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তা লন্ডনে জানান, কয়েকজন জ্যেষ্ঠ সৌদি প্রিন্সের সঙ্গে এরই মধ্যে দুটি বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে সৌদি প্রিন্সরা জানিয়ে দিয়েছেন, এখন আর ইসরায়েলকে শত্রু ভাবছেন না তাঁরা!
একটি বিষয় লক্ষণীয়, জোটের বিষয়ে ইসরায়েল বক্তব্য দিচ্ছে বেশি। সৌদি আরব আনুষ্ঠানিকভাবে এ নিয়ে কথা বলেনি, কিন্তু অস্বীকারও করছে না। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই বিষয়গুলো কাকতালীয়ভাবে হচ্ছে না। বরং ইরানকে সতর্ক করার জন্য পরিকল্পিতভাবেই ইসরায়েলের সঙ্গে নিজেদের সম্ভাব্য জোটের কথা নানা মাধ্যমে জানাচ্ছে সৌদি আরব।
তেল আবিব বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটি স্টাডিজের জ্যেষ্ঠ গবেষক কোবি মাইকেলের মতে, ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার বিষয়টিকে এখন ‘বোঝা’ মনে করছে সৌদি আরব। দেশটি এখন কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ অন্যান্য ইস্যু নিয়ে কাজ করতে চাইছে।
কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরাকে কোবি মাইকেল বলেন, ‘মিসর, জর্ডান ও অন্য উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোর (কাতার বাদে) জন্য দুটি প্রধান হুমকি রয়েছে। একটি ইরান, অন্যটি হলো উগ্রপন্থী সালাফি মতবাদ। এ অঞ্চলে একটি শূন্যতা সৃষ্টি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। আর সেটি পূরণ করছে রাশিয়া ও ইরান। এমন পরিস্থিতিতে সৌদি আরব মনে করেছে, এটিই ইসরায়েলের সঙ্গে মিত্রতা গড়ার সঠিক সময়।’
কিন্তু শুধু কি ইরানের জন্যই এক মঞ্চে দাঁড়াচ্ছে ইসরায়েল ও সৌদি আরব? কিছু বিশ্লেষক আঙুল তুলছেন, সৌদি আরবে সাম্প্রতিক সময়ে চালানো সংস্কার কার্যক্রমের দিকে। সৌদি আরবের বর্তমান যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান মনে করছেন, ভবিষ্যতে উন্নতি করতে হলে পুরো মধ্যপ্রাচ্যেই পরিবর্তন আনতে হবে। আর সেই পালাবদল নিজের দেশ থেকে শুরু করেছেন তিনি।
কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক মাহজুব জুয়েইরি আল-জাজিরাকে বলেন, ‘সৌদি আরবের রাজনৈতিক পরিবর্তন এবং সেখানে ক্ষমতা সংহত করার আকাঙ্ক্ষাই ইসরায়েলের সঙ্গে দেশটির দ্বিপক্ষীয় জোটের বিষয়টি প্রকাশ্যে নিয়ে এসেছে। এ ক্ষেত্রে ইরান স্রেফ ছুতো। তবে এর ফলে ইরানের বরং সুবিধাই হবে। মধ্যপ্রাচ্যে ইরান নিজেদের ভাবমূর্তিকে আরও উজ্জ্বল করার সুযোগ পাবে।’
বিবিসির বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক দুর্বল অবস্থানই সৌদি আরবকে ইসরায়েলের পাশে ঠেলে দিয়েছে। প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ডোনাল্ড ট্রাম্প দুটি দেশই সফর করেছেন। সৌদি আরব ও ইসরায়েলের পক্ষে আছে যুক্তরাষ্ট্র—সেটিও ট্রাম্পের নানা কথায় স্পষ্ট হয়েছে। একই সঙ্গে ইরানের সঙ্গে হওয়া পরমাণু চুক্তি নিয়ে নিজের সন্দেহের কথাও জানিয়ে দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। কিন্তু মুখে সহমর্মিতা দেখানো ও বাস্তবের কৌশল—দুটি ভিন্ন বিষয়। এখন জোটবদ্ধ হয়ে মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের স্বার্থরক্ষা করাই ইসরায়েল ও সৌদি আরবের মূল লক্ষ্য। যুক্তরাষ্ট্রের প্রবল প্রতাপের অনুপস্থিতিতে তা আরও অবশ্যম্ভাবী হয়ে দেখা দিয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক খলিল শাহিন থাকেন গাজার পশ্চিম তীরের রামাল্লা শহরে। আল-জাজিরাতে প্রকাশিত এক নিবন্ধে তিনি বলেন, ‘মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি আগে যে কাজ করত, এখন তার জায়গা নিচ্ছে ইসরায়েল। মূলত বিভিন্ন আরব দেশের কর্তৃত্ববাদী শাসকেরা নিজেদের টিকিয়ে রাখতে শক্তিশালী রাষ্ট্রের ছায়ায় যেতে চাইছেন।’
খলিল শাহিন বলেন, ইরান পরমাণু শক্তিধর দেশ। অন্যদিকে, ইসরায়েলের আছে শক্তিশালী সামরিক বাহিনী, পারমাণবিক অস্ত্র ও উন্নত প্রযুক্তি। রাজনৈতিকভাবে নিজেদের কর্তৃত্ব ধরে রাখতে তাই স্বাভাবিকভাবেই ইসরায়েলের প্রতি মিত্রতায় আগ্রহী হচ্ছে আরব দেশগুলো।
এখন প্রশ্ন হলো, ইসরায়েল ও সৌদি আরবের এই জোট কত দিন টিকবে?
জবাব খোঁজার আগে আরও কিছু প্রশ্নের উত্তর পেতে হবে। যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান তাঁর চালানো সংস্কার কাজে সাফল্য পাবেন কি না, তা এখানে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। আঞ্চলিক রাজনীতিতে এর কী প্রভাব পড়ে, এটিও বিবেচনার বিষয়। মূলত ফিলিস্তিনি শান্তিপ্রক্রিয়া সফল হলেই সৌদি-ইসরায়েল জোটের দীর্ঘ মেয়াদে টিকে থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ, সৌদি আরব অনেক দিন থেকেই বলে আসছিল যে আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেওয়ার আগে ফিলিস্তিনি সমস্যার সমাধান প্রয়োজন। এর সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের মানুষের সাধারণ আবেগও জড়িয়ে আছে। সুতরাং, ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে কার্যকর শান্তিপ্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠিত না হলে সৌদি-ইসরায়েল জোটের ভবিষ্যৎও উজ্জ্বল থাকবে না।
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)
একই রকম সংবাদ সমূহ
পাকিস্তানে শক্তিশালী ভূমিকম্পে ১৯ জনের মৃত্যু
পাকিস্তানের উত্তরাঞ্চলে শক্তিশালী ৫ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্পের আঘাতে ১৯বিস্তারিত পড়ুন
২৪ ঘণ্টার মধ্যে ধেয়ে আসছে ঘূর্ণিঝড় হিক্কা
ধেয়ে আসছে প্রবল ঘূর্ণিঝড় হিক্কা। এর ফলে ঝড়ের পাশাপাশি ভারীবিস্তারিত পড়ুন
টিকাদানের সাফল্যে ‘ভ্যাকসিন হিরো’ পেলেন প্রধানমন্ত্রী
টিকাদানের সাফল্যে ‘ভ্যাকসিন হিরো’ পেলেন প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশে টিকাদান কর্মসূচি একটিবিস্তারিত পড়ুন